শেষের পাতা
বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৭ জুন ২০২৫, শুক্রবার
নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সরকারের পরিকল্পনায় হতাশ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত গুরুত্ব পায়নি বরং ফসিল ফুয়েল নির্ভরতা আরও বাড়ানো হয়েছে। বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার কিছুটা ভুল উপায়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করছে বলে মনে করে সিপিডি।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত: জ্বালানি রূপান্তরের অগ্রাধিকারের ওপর প্রতিফলন’ শীর্ষক সিপিডি’র সংলাপে এসব কথা বলা হয়।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র সহযোগী গবেষক হেলেন মাশিয়াত প্রিয়তী। উপস্থাপনকালে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের যে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা তিনটি শূন্য (শূন্য দারিদ্র, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ)। সেদিক বিবেচনায় আমরা ২.৫০ শূন্যে দাঁড়িয়েছি। কারণ আমাদের বাজেট জ্বালানি খাতে কয়লার নির্ভরতার কথা বলছে, এলএমজি আমদানির কথা বলছে। খুব বেশি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে প্রাধান্য দেয়া হয়নি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে কোনো ধরনের প্রণোদনা দেয়া হয়নি। এসব যখন আমরা দেখছি, তখন বলতে হচ্ছে শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার উল্টো পথে হাঁটছে। যেখানে এক পা এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে এক পা পিছিয়ে যাচ্ছে। আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম যদি বাজেটে প্রো-ফসিল ফুয়েল না হয়ে প্রো-রিনিউয়েবল ফুয়েল হতো। প্রবন্ধ উপস্থাপনায় প্রিয়তি আরও বলেন, বাজেটে আমরা এলএমজি আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেখতে পেলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে কোনো প্রণোদনা দেয়া হয়নি। বরং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বরাদ্দ কমেছে। এক্ষেত্রে আমরা বিপরীত চিত্র দেখতে পেলাম। এবার মাত্র ৭টি প্রকল্পে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দেয়া হয়েছে, গত বছর ৪টি প্রকল্পে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ছিল। সেদিক থেকে আমরা ইতিবাচক বলা যায়। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে কম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যদিও বাজেট বক্তব্যে বিশেষ তহবিলের কথা এসেছে। যেখানে ৭০০ কোটি টাকার তথ্য এসেছে, তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করি।
সিপিডি জানায়, আমাদের বিভিন্ন জ্বালানি তেল বা গ্যাসের দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। সেটা আমাদের কাছে মনে হয়েছে কিছুটা ভুল উপায়ে মূল্যগুলো সমন্বয় করা হচ্ছে। যাতে করে আমাদের আর্থিক বোঝার ওপর একটা প্রভাব পড়ছে। আমাদের সেই আর্থিক বোঝা সেগুলো অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দেনাগুলো আছে সেগুলোর পেমেন্টগুলো ডিউ রয়ে গেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৮টি সংকট রয়েছে। সেগুলো হলো- নিয়ন্ত্রক সংস্থার আর্থিক সংকট, গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহ সরবরাহে ব্যর্থতা, ভুল উপায়ে জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করা, জ্বালানি রূপান্তরের গতি কমে যাওয়া ইত্যাদি। হেলেন মাশিয়াত প্রিয়তি বলেন, বিগত সময়ের মতো এবারের বাজেটও প্রো-ফসিল ফুয়েল রয়ে গেছে। বরং নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিবেচনায় বিগত বাজেট হতাশ করেছে।
সংলাপে সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমরা সবাই অবগত যে, এই বাজেটটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও পরবর্তী নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করবে। এর রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। বাজেটে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। বিগত সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ হয়েছে তার বিপরীতে হয়তো জ্বালানি প্রাপ্যতা বেড়েছিল। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা দেখেছি গুণমানসম্পন্ন বিদ্যুৎ- জ্বালানি পাওয়া বা জ্বালানি রূপান্তরের বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়া সেই কাজগুলো হয়নি। বরং এই সময়গুলোতে ব্যাপক লুটপাট হতে দেখেছি। অর্থের অপচয় হতে দেখেছি, সুশাসনের অভাবের মতো বড় সমস্যা বিগত সরকারের আমলে দেখেছি। তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যাশা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সুশাসন গত দুর্বলতা অন্তর্বর্তী সরকার চিহ্নিত করবে। জ্বালানি রূপান্তরের জায়গায় কার্যকর ভূমিকা নেবে, নীতি কাঠামোতে আরও বেশি ভারসাম্য ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই জ্বালানির বিষয়টি তারা গুরুত্ব দেবেন।
সিপিডি জানায়, স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থার আওতায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ২ হাজার ৫০ কোটি টাকা লাভ করেছে। শুধু বিপিসি নয়, পেট্রোবাংলার অধীন দু’টি প্রতিষ্ঠান বাপেক্স ও আরপিজিসিএল-ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে লাভ করেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী, বাপেক্সের মুনাফা হয়েছে ১৩৭ কোটি টাকা এবং আরপিজিসিএলের মুনাফা ৪১ কোটি টাকা। শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে এই অর্জিত হয়। সিপিডি’র পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাপেক্সের মুনাফা বেড়ে ২৫৮ কোটি এবং আরপিজিসিএলের মুনাফা ৪৯ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট মওকুফ এবং গ্যাসের দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনার মুখে এমন প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বিপুল লোকসানের মুখে রয়েছে। সিপিডি বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিপিডিবি’র লোকসান হয়েছে ৮ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা এবং আগামী অর্থবছরে লোকসান বেড়ে ৯ হাজার ৪৩ কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে।
জ্বালানি রূপান্তরের লক্ষ্য পুনরুদ্ধারে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে সিপিডি। এরমধ্যে রয়েছে- জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কর ছাড় বাতিল করা, জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক যন্ত্রপাতি আমদানিতে কার্বন কর ও শুল্কারোপ, জীবাশ্ম জ্বালানি ও এলএনজি’র সকল ভর্তুকি তুলে নেয়া, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল ব্যবহার করে ঘরোয়া গ্যাস অনুসন্ধান অগ্রাধিকার দেয়া, অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র ধাপে ধাপে বন্ধ করা, আগাম অনুমোদনপ্রাপ্ত স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী চুক্তি পুনরায় আলোচনার মাধ্যমে পরিমার্জন করা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং আমদানিকৃত সরঞ্জামে শুল্ক ও ভ্যাট কমানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য একটি ভর্তুকি তহবিল তৈরি, স্মার্ট গ্রিডে বিনিয়োগ বাড়ানো-যাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে সহজে যুক্ত করা যায়, স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিবর্তে স্বল্প সুদের বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়ন চাওয়া এবং ২০৪০ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা মাথায় রেখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতি পর্যালোচনা করা। আসন্ন অর্থবছর সরকারের জলবায়ু ও জ্বালানি রূপান্তর অঙ্গীকার রক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হবে বলে মন্তব্য করেছে সিপিডি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চ্যুয়ালি যোগ দেন জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন ভোক্তা অধিকার সমিতির (ক্যাব) সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরুল ইমাম, বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি ব্যারিস্টার বিদ্যা অমৃত খান, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মনোয়ার মোস্তফা এবং বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি মো. আখতার হোসেন অপূর্ব।