অনলাইন
হারি রায়া হাজি
ফুড হ্যাভেন মালয়েশিয়ার ভিন্ন স্বাদের কুরবানির ঈদ
আরিফুল ইসলাম, মালয়েশিয়া
(৪ ঘন্টা আগে) ৮ জুন ২০২৫, রবিবার, ১২:৪৬ অপরাহ্ন

মালয়েশিয়ায় ঈদুল আজহা, যাকে স্থানীয়ভাবে ‘হারি রায়া হাজি’ নামে অভিহিত করা হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। এই দিবসটি হজ পালনের স্মৃতিচারণ এবং কুরবানির তাত্ত্বিক তাৎপর্যের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়। মালয়েশিয়ার প্রেক্ষাপটে এ উৎসব ধর্মীয় বিধান, সামাজিক ঐক্য এবং স্থানীয় সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয়ে পরিপূর্ণ।
ঈদের দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষিত হয় এবং দিনের সূচনা হয় ফজরের পর গোসল ও পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধানের মাধ্যমে। মুসলমানরা স্থানীয় মসজিদে গমন করে ঈদের নামাজ আদায় করেন। শহর ও গ্রামের মসজিদে বিপুল মুসল্লির সমাগম ঘটে এবং নামাজ শেষে সকলে একে অপরকে ‘সেলামাত হারি রায়া হাজি’ বলে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন।
ঈদের প্রধান অনুষঙ্গ হলো কুরবানি। নামাজের পর গরু, ছাগল কিংবা ভেড়া কুরবানি দেয়া হয়। মালয়েশিয়ায় কুরবানির কার্যক্রম অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক এবং স্বাস্থ্যবিধি-সম্মতভাবে সম্পন্ন হয়। স্থানীয় মসজিদ, ইসলামিক সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনসমূহ পুরো প্রক্রিয়াটি তত্ত্বাবধান করে থাকে। কুরবানির মাংস তিনভাগে বিভক্ত করে—এক অংশ পরিবারের জন্য, এক অংশ আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং অপর অংশ দরিদ্র ও অভাবীদের মাঝে বিতরণ করা হয়।
ঈদের দিনে মালয় পরিবারগুলো ঐতিহ্যবাহী খাবার প্রস্তুত করে, যার মধ্যে নাসি হিমপিত, রেনডাং, কেতুপাৎ, লেমাং, সাতে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই খাবারগুলো পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী এবং অতিথিদের সঙ্গে ভাগ করে খাওয়ার মাধ্যমে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।
ঈদের অন্যতম সামাজিক দিক হলো পারিবারিক পুনর্মিলন। শহরে অবস্থানরত কর্মজীবীরা ঈদের সময় গ্রামে ফিরে যান বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করেন। একজন আরেকজনের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও সম্পর্ক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে সামাজিক বন্ধন মজবুত হয়। বহু মুসলিম পরিবার ঈদের দিনে কবরস্থানে গিয়ে প্রয়াত স্বজনদের কবর জিয়ারত করেন, দোয়া করেন এবং ফুল অর্পণ করেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুশীলন, যা মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা ও স্মৃতিচারণার বহিঃপ্রকাশ।
ঈদের আমেজকে ঘিরে মালয়েশিয়ার গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় বিভিন্ন বিশেষ অনুষ্ঠান, নাটক, আলোচনা ও সংগীতানুষ্ঠান। ঈদের আগে ও পরে সমগ্র দেশজুড়ে বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ। মালয়েশিয়ায় ঈদ উদযাপন একাধারে ধর্মীয় অনুশাসন ও স্থানীয় সংস্কৃতির সম্মিলন। অতিথিপরায়ণতা, ঐতিহ্যবাহী পোশাক, খাবার এবং পারিবারিক মূল্যবোধ—সব মিলিয়ে ঈদ হয়ে ওঠে একটি জাতীয় ঐক্যের উৎসব। পুরুষেরা বাজু মেলায়ু ও সামপিন এবং নারীরা বাজু কুরুং বা কেবায়া পরে ঈদের সাজ সম্পূর্ণ করেন।
এ প্রেক্ষাপটে ওরাং আসলি মুসলিমদের ঈদ উদযাপনেও পরিলক্ষিত হয় তাদের স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য। তারা সাধারণত ইসলামিক সংস্থা বা সরকারি সহায়তার মাধ্যমে কুরবানি সম্পন্ন করে। কুরবানির মাংস রান্নার ক্ষেত্রে ওরাং আসলিদের রান্নার ধরণ ভিন্ন ও অনন্য। তারা মূলত প্রাকৃতিক উপাদান এবং বনজ উৎসের ওপর নির্ভরশীল। বাঁশের খোলস ব্যবহার করে তারা মাংস, লবণ, পেঁয়াজ এবং বনজ মসলা—যেমন বুনো আদা, জংলি মরিচ, লেবুপাতা ও সেরাই (লেমনগ্রাস)—সহ ভরে আগুনে সেদ্ধ করে। এই প্রক্রিয়াকে তাদের ভাষায় ‘পাঙ্গান’ বা ‘লেমাং স্টাইল’ বলা হয়। এতে মাংসের স্বাদে আসে এক প্রকার প্রাকৃতিক ঘ্রাণ ও মসৃণতা।
এছাড়াও, তারা কখনো আগুনে সরাসরি মাংস ঝলসে বা ফুটন্ত পানিতে সিদ্ধ করে রান্না করে। আধুনিক মসলা বা প্রস্তুতকৃত মিক্স ব্যবহার না করে তারা সহজলভ্য উপাদান দিয়ে মাংসের প্রাকৃতিক স্বাদ বজায় রাখেন। এই রান্না কেবল খাদ্য প্রস্তুতির প্রক্রিয়া নয়, বরং একটি পারিবারিক-সামাজিক আচার, যেখানে পুরো সম্প্রদায় একত্র হয়ে রান্না ও ভোজনের আনন্দ ভাগ করে নেয়।
মোটকথা, মালয়েশিয়ায় ঈদুল আজহার উদযাপন কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং সামাজিক সংহতি, সংস্কৃতির গৌরব এবং জাতিগত বৈচিত্র্যের মেলবন্ধন। ধর্মীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতির সম্মান ও সংরক্ষণই এই উৎসবকে করে তোলে সত্যিকার অর্থে প্রাণবন্ত ও অর্থবহ।