প্রথম পাতা
এটিএম আজহার বেকসুর খালাস
স্টাফ রিপোর্টার
২৮ মে ২০২৫, বুধবার
মানবতা-বিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে করা আপিল মঞ্জুর করে তাকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন উচ্চ আদালত। মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিক্রমে এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য ছয় বিচারপতি হলেন- বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি ইমদাদুল হক, বিচারপতি মো. আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। আদালতে এটিএম আজহারের পক্ষে ছিলেন- আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার ইমরান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন। প্রসিকিউশন পক্ষে ছিলেন- আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন- অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনিক আর হক।
রায় ঘোষণার আগেই সকাল ৯টার দিকে আপিল বিভাগে আসেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’সুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, এভাকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসেন, মাওলানা আব্দুল হালিম, এভাকেট মতিউর রহমান, মাসুদ সাঈদী, জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তরের আমীর মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নায়েবে আমীর ড. হেলাল উদ্দিন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন, জামায়াত নেতা কামাল হোসাইন, ছাত্র শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. ফখরুদ্দিন মানিকসহ শীর্ষ নেতারা।
আদালতের পর্যবেক্ষণ: সকাল ৯ টা ৫০ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাত বিচারপতি এজলাসে ওঠেন। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম আইনি বিষয় তুলে ধরেন। এরপর রায় ঘোষণা শুরু হয় ৯টা ৫৫ মিনিটে। রায় ঘোষণার আগে আপিল বিভাগ বলেন দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, যেসব তথ্য প্রমাণ হাজির করা হয়েছিল আগের আপিল বিভাগ তা সঠিকভাবে পর্যালোচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। আজহারের ফাঁসির রায় ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে বিচারের নামে অবিচার। শিশির মনির আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। বলেন, পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এই বিচারে উপমহাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি ও রীতিনীতি পাল্টে দেয়া হয়েছিল। সাক্ষ্য-প্রমাণ অ্যাসেসমেন্ট ছাড়াই আজহারুল ইমলামকে ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছিল। নজিরবিহীনভাবে বিচারের নামে অবিচার করা হয়েছিল। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, যেসব তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়েছিল আগের আপিল বিভাগ সঠিকভাবে পর্যালোচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। শিশির মনির বলেন, এই মামলার আগের রায়ে বাংলাদেশেসহ এই ভারতীয় উপমহাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা বদলে দেয়া হয়েছিল, যেটা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। এছাড়া আদালতের সামনে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ কোনো অ্যাসেসমেন্ট ছাড়াই এটিএম আজহারুল ইসলামকে ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছিল। যেটি ছিল বিচারের নামে অবিচার। আর যে সমস্ত তথ্য প্রমাণ আদালতের সামনে হাজির করা হয়েছিল, অতীতের আপিল বিভাগ সেটা সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়।
অতীতের রায়গুলোও পুনর্বিবেচনা করা উচিত: শিশির মনির
আজহারুলের আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আমরা মনে করি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অতীতের অনেক রায় সম্পর্কে এ রায়ে অনেক পর্যবেক্ষণ থাকবে। আমরা মনে করি সরকারের উচিত হবে এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর একটি রিভিউ বোর্ড গঠন করে অতীতের রায়গুলোকে পুনর্বিবেচনা করা, যেন মৃত্যু পরবর্তীতে হলেও যাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, অবিচার করা হয়েছে, তাদের পরিবার, তাদের দল ও এ দেশের মানুষ ন্যায়বিচার পেতে পারে। এই রায় শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমে আমরা মনে করি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সত্য বিজয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাভূত হয়েছে। এই রায়ের ফলে সিন্ডিকেটেড অবিচারের অবসান হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন যা বলেন: দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়কে মেনে নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বিভাগ। রায় ঘোষণার পর হাইকোর্টের সামনে তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম বলেন, প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে আমরা মেনে নিয়েছি এবং আমরা এটি মেনে নিতে বাধ্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আজ এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার রায়ের দিন ধার্য ছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আমরা রায় গ্রহণের জন্য আপিল বিভাগে উপস্থিত ছিলাম। একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত কোনো রায়ের ব্যাপারে মন্তব্য করাকে আমি আইনসিদ্ধ মনে করি না। তবে আমরা শুনানিতে যে প্রসঙ্গে কথা বলেছিলাম, আজকের এই রায়ে আমরা তারই প্রতিফলন দেখতে পেয়েছি। গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম বলেন, এটিএম আজহারুল ইসলামের পক্ষে তাদের যে মূল সাবমিশনটা ছিল, সেটি হলো- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যে জাজমেন্ট ৫ই আগস্টের আগে হয়েছে, সেগুলোতে আন্তর্জাতিক আইনের প্রযোজ্যতা ছিল না। আপিল বিভাগও এটিকে অ্যাফার্ম করেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে আন্তর্জাতিক আইনের প্রযোজ্যতা প্রয়োজন নেই। এই যুক্তিতর্কের ব্যাপারে প্রসিকিউশন প্রথম থেকেই বলেছে, এই যুক্তি-তর্কের ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কারণ এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এখানে আন্তর্জাতিক আইনের ডেফিনেশন অব ক্রাইমস এবং মুডস অব লায়্যাবলিটির প্রযোজ্যতা প্রয়োজন। তা না হলে আমরা যে সমালোচনা আগে ট্রাইব্যুনালের রায়ের ক্ষেত্রে করেছি, এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নয়, সেটি বহাল রয়ে যায়। এজন্য আমরা আপিল বিভাগে সাবমিশন রেখেছিলাম, আন্তর্জাতিক আইনের প্রযোজ্যতা প্রয়োজন। এটি যে প্রসিকিউশন এবং বর্তমান সরকার চায়, তার প্রমাণ হলো আমরা প্রসিকিউশনে যোগদানের পর পরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ কে সংশোধন করে আন্তর্জাতিক আইনের প্রযোজ্যতাকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এজন্য আজ আপিল বিভাগ যখন বলেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে আন্তর্জাতিক আইনের প্রযোজ্যতা প্রয়োজন, এই ব্যাপারে আমাদের প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে এখনো একমত পোষণ করছি এবং এই রায়ের পক্ষে এখনো কথা বলছি। তিনি আরও বলেন, আজহারুলের মামলায় যে মেরিটগুলো ছিল, সেগুলোর ব্যাপারে আমরা আপিল বিভাগে বলেছিলাম, এটি আপ টু ইউর লর্ডশিপ ডিসিশন। লর্ডশিপ এই মেরিট বিবেচনায় এটিএম আজহারুল ইসলামকে খালাস দিয়েছেন। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে রায়কে আমরা মেনে নিয়েছি এবং আমরা এটি মেনে নিতে বাধ্য।
মিলতে পারে হাসপাতাল থেকেই মুক্তি: প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম জানান, গতকাল বিকালেই মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পাওয়া আজহারুল ইসলামের আদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছে। এরপর ট্রাইব্যুনাল মুক্তির আদেশ কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। কারাবন্দি ওই নেতা বর্তমানে কেরানীগঞ্জ কারাগারের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন। সেখান থেকেই সকালে মুক্তি পাবেন বলে জানা গেছে। শিশির মনির বলেন, ইনশাআল্লাহ্, আশা করি বুধবার সকালে এটিএম আজহারুল ইসলাম মুক্তি পাবেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার একেএএম মাসুম বলেন, এটিএম আজহারুল ইসলামের আপিল মঞ্জুরের কাগজপত্র এলে যাচাই-বাছাই করে সবকিছু ঠিক থাকলে উনাকে হাসপাতাল থেকেই মুক্তি দেয়া হবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার মামলায় ২০১৪ সালের ৩০শে ডিসেম্বর এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০১৯ সালের ৩১শে অক্টোবর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এরপর ওই রায় রিভিউ চেয়ে ২০২০ সালের ১৯শে জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়। চলতি বছরের ২৬শে ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ রিভিউ শুনানি শেষে এটিএম আজহারুল ইসলামকে আপিলের অনুমতি দেন। পাশাপাশি দুই সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিতে বলা হয়। পরে আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেয়া হয়। আপিলের ওপর শুনানি শেষে গত ৮ই মে রায়ের জন্য দিন ঠিক করে দেন আপিল বিভাগ। সে অনুযায়ী গতকাল রায় দেয়া হয়।
পাঠকের মতামত
বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছিল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ এবং খুনি হাসিনা। আলহামদুলিল্লাহ, আশা করি বিচার বিভাগ ক্রমান্বয়ে নায়পরায়নতার দিকে যাবে।