ঢাকা, ৩০ মে ২০২৫, শুক্রবার, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১ জিলহজ্জ ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

২৪ দিনে হাজারের বেশি পুশইন

শুভ্র দেব
২৯ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার
mzamin

দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পুশইন থামছেই না। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশে পুশইন শুরু করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। ৪ঠা মে থেকে শুরু করে গতকাল পর্যন্ত ২৪ দিনে দেশের ১৭টি জেলা দিয়ে ৯৭৫ জনকে পুশইন করেছে। এর বাইরে সুন্দরবন দিয়ে আরও ৭৮ জনকে পুশইন করা হয়েছে। পুশইন নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে অন্তত চার দফা কূটনৈতিক প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। দিল্লী এখনো এসব বিষয় নিয়ে কোনো সাড়া দেয়নি। বরং উল্টো গতকালও সিলেট সুনামগঞ্জ জেলা দিয়ে ৮২ জনকে পুশইন করা হয়েছে। এ ছাড়া লালমনিরহাট জেলা দিয়ে পুশইন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে বিএসএফ। পুশইন বন্ধ না হওয়াতে বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কে আলোচনার নতুন ইস্যু তৈরি হয়েছে। 

বিজিবি সদরদপ্তরের তথ্যমতে, গত ৭ই মে থেকে এখন পর্যন্ত ৯৭৫ জনকে পুশইন করা হয়েছে। এরমধ্যে খাগড়াছড়ি জেলার সীমান্ত দিয়ে ১১১, কুড়িগ্রামে ৮৪, সিলেটে ১০৩, মৌলভীবাজারে  ৩৩১, হবিগঞ্জে ১৯, সুনামগঞ্জে ১৬, দিনাজপুরে ২, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৭, ঠাকুরগাঁও ১৯, পঞ্চগড়ে ৩২, লালমনিরহাটে ৭৫, চুয়াডাঙ্গায় ১৯, ঝিনাইদহে ৪২, কুমিল্লায় ১৩, ফেনীতে ৩৯,  সাতক্ষীরায় ২৩ এবং মেহেরপুরে ৩০ জন।  এ ছাড়া সুন্দরবনের গহীন অরণ্যের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় ৭৮ জনকে পুশইন করা হয়েছে। বিজিবি জানিয়েছে, যাদের পুশইন করা হচ্ছে তাদের অধিকাংশই দীর্ঘদিন ধরে ভারতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিল। তাদের মধ্যে অনেকে ভারতীয় পুলিশের হাতে আটক হয়ে জেলও খেটেছে। কিন্তু বিএসফ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুরসরণ না করেই পুশইন করছে। এ ছাড়া পুশইন করা অনেকেই ভারতের নাগরিক বলেও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। 

সীমান্তে পুশ-ব্যাক বা পুশ-ইন বলতে বোঝায় এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ধরা পড়া ব্যক্তিদের সীমান্তে নিয়ে গিয়ে অন্য দেশের ভূখণ্ডে ঠেলে দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়ার কোনো আইনি স্বীকৃতি ভারতে নেই, তবে দীর্ঘদিন ধরেই এটি চলে আসছে। যদিও সরকারিভাবে কেউই এই পদ্ধতিকে স্বীকার করে না, তথাপি তা বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে। অনেকের মতে, ভারতের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দ্বিপক্ষীয় চুক্তির পরিপন্থি। দেশটি বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির নতুন কৌশল হিসেবে ‘পুশইন’ শুরু করেছে। এ ছাড়া এটি রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির কৌশল বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।  ভারতের মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ভারত থেকে এভাবে পুশ-ব্যাক করা সম্পূর্ণই আইনবহির্ভূত। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পুশইন ইস্যুতে পর্যায়ক্রমে ৮, ১৩, ১৫ ও ২০ মে এই চার দফায় ভারতকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। এসব চিঠিতে পুশইনের ঘটনাকে ‘গভীর উদ্বেগজনক’ এবং দুই দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা ও জনমনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরির হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়, ১৯৭৫ সালের যৌথ সীমান্ত নির্দেশিকা, ২০১১ সালের সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা এবং বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের আলোচনার চুক্তিগুলোর সঙ্গে এসব কর্মকাণ্ড সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, পুশইন ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে সীমান্ত পর্যায়ে সমন্বয় জোরদার করা উচিত। একইসঙ্গে ভারতের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে, মিয়ানমারের নাগরিকদের যেন বাংলাদেশে না ঠেলে পাঠিয়ে আদি নিবাস মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। এদিকে ১৫ই মে ভারতের পক্ষ থেকে একটি চিঠিতে জানানো হয়, বাংলাদেশের কোনো অভিযোগই তারা মেনে নিচ্ছে না, বরং এটি কোনো প্রমাণ ছাড়া তোলা অভিযোগ। সর্বশেষ ২১শে মে ভারত আবারো চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশকে জানায়, তারা ২,৪৬১ জনের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের অনুরোধ আগেই পাঠিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সেই যাচাই সম্পন্ন করেনি। এ নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা  মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, ভারতীয় তালিকা যাচাই করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এখনো পুশব্যাক বা পাল্টা পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা সাধারণত পুশব্যাক করি না। তবে যাদের প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, তাদের অবশ্যই ভারতকে ফেরত নিতে হবে। কূটনৈতিক চ্যানেল ছাড়াও পুশইন নিয়ে বিজিবিও প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিজিবি জানিয়েছে, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পুশইন করায় বিএসএফের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে জোরালো প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া পুশইন রোধে বিজিবি সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল তৎপরতা বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। 

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ১৭ই মে শনিবার সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় বলেছেন, ভারত যেভাবে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে মানুষ ঠেলে (পুশইন) দিচ্ছে, তা আইনসিদ্ধ নয়।  পুশইন সমস্যার বিষয়ে বাংলাদেশ কূটনৈতিক সমাধানে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ সব সময় আন্তর্জাতিক আইন ও প্রটোকল অনুসরণ করে আসছে। আমরা ইতিমধ্যে এ সমস্যা সমাধানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতকে চিঠি লিখেছি। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এ সমস্যার সমাধানে কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের তরফ থেকে ভারতকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশি কেউ যদি অবৈধভাবে ভারতে থেকে থাকেন, তবে ভারত যেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠায়। আর বাংলাদেশে যদি অবৈধ ভারতীয় নাগরিক থেকে থাকেন, তাদেরও যথাযথ চ্যানেলের মাধ্যমে ভারতে ফেরত পাঠানো হবে। সে জন্য ভারতীয় পক্ষকে বলা হয়েছে, তারাও যেন পুশইন না করে যথাযথ চ্যানেলে ফেরত পাঠায়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, বাংলাদেশে পুশইন করা ব্যক্তিদের মধ্যে ইউএনএইচসিআর-এর কার্ডধারী কিছু রোহিঙ্গাও রয়েছে। আবার যারা ভারতীয় রোহিঙ্গা, তাদেরও পুশইন করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সে জন্য আমরা একটা প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছি। আর ২৭শে মে রাজশাহীর কারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত নবীন রিক্রুট ১৪তম ব্যাচ ডেপুটি জেলার এবং ৬২তম ব্যাচ কারারক্ষী ও নারী কারারক্ষী প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সীমান্তে পুশইন ইস্যুতে ভারতের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশিদের প্রোপার চ্যানেলের মাধ্যমে ফেরত পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে।  এ সময় তিনি বলেন, সীমান্তে কোনো সুরক্ষা ঘাটতি নেই। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের বাহিনী সম্পূর্ণ সক্ষম ও প্রস্তুত।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status