শেষের পাতা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাটাই যেন এক পোড়া গ্রাম
স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে
২৭ মে ২০২৫, মঙ্গলবার
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাটাই যেন এক পোড়া গ্রাম। বাড়িতে বাড়িতে পুড়ে যাওয়া ঘর, ঘরের আসবাবপত্রসহ সবকিছু পুড়ে কয়লা হওয়ার চিহ্ন। গ্রামের দুই গোষ্ঠীর কয়েক দিনের লাগাতার বিরোধে বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট ছাড়াও ঘটে হতাহতের ঘটনা। আর এতে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়ে। মৃত্যুর ঘটনার পর প্রতিপক্ষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ঘটনার পর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রামের কয়েকশ’ নারী, পুরুষ, শিশু। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি দেখতে নারীরাও যেতে পারছেন না। গ্রামে গেলেই ধাওয়া করা হচ্ছে তাদের। অভিযোগ গ্রামে একটি পক্ষ রাজত্ব করছে এখন। সময়ে সময়ে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে অবশিষ্ট মালামাল লুট করে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ত পুলিশের দাবি তাদের টহল রয়েছে সেখানে। গত এক মাসের বেশি সময় ধরে গ্রামটিতে চলছে এই অবস্থা।
বাড়ির নাম সুখের নীড়। প্রতিবন্ধী শাহজাহান মিয়ার চার কন্যার স্বপ্নের দালান ঘরে দেয়া হয় আগুন। চালানো হয় লুটপাট। বাড়িতে ফিরতে পারছেন না মেয়েরা। আকলিমা, মোসলেমা, তানিয়া ও খাদিজা। পুত্রহীন শাহজাহান মিয়ার মৃত্যুর পর ৪ কন্যা তাদের কষ্টার্জিত অর্থে দালান করার স্বপ্ন বুনেন। তাতে সহায়তা করেন বিবাহিত বোনদের স্বামীরা। ২০২৩ সালে ৪ শতাংশ জায়গার অর্ধেকের বেশিতে চারতলা ফাউন্ডেশনের বাড়ি করার কাজ শুরু হয়। ২০২৪ সালে একতলা সম্পন্ন হয়। ওই বাড়িতেই বসবাস করছিল শাহজাহান মিয়ার স্ত্রী ও ৩ কন্যা সন্তান। আরেক মেয়ে তানিয়া আক্তার স্বামীর বাড়িতে থাকেন। বড় বোন আকলিমার স্বামী প্রবাসী। স্বামী-সন্তানসহ ওই বাড়িতেই বসবাস তার। আকলিমা বলেন, আমরা সুখেই ছিলাম। এক বোন মুসলেমা আক্তার দর্জির কাজ এবং ছোট বোন খাদিজা আক্তার উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশুনার পাশাপাশি টিউশনি করে। দুটো সেলাই মেশিন ছিল। অনেক কাপড় ছিল। সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে গেছে। দু’টি রুমে আগুন দিয়ে সবকিছু পুড়িয়ে দিয়েছে। সবাই মিলে ৩০ লাখ টাকা খরচ করে বাড়িটি করেছিলাম। ঘটনার সময় আমি শহরের মেড্ডায় ছিলাম। খবর পেয়ে বাড়িতে গেলেও ঘরে ঢুকতে পারিনি। পালিয়ে চলে আসি। ঘরে আগুন আর লুটপাটে সর্বস্ব হারিয়েছেন নাটাই গ্রামের আরও অনেক পরিবার।
নাটাই পূর্বপাড়ার মজিবুর রহমানে স্ত্রী শরীফা বেগম (৫০) জানান, তার বাড়িতে প্রথম আগুন দেয়া হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় ২টি ঘর। মৃত্যুর ঘটনার পরপরই তার বাড়িতে হামলা হয়। সে সময় তাকে এবং তার বড় ছেলে মাসুদের স্ত্রী ইভা, ভাইঝি ও ২ নাতি-নাতনিকে হামলাকারীরা মারধর করে। ইভার মাথায় আঘাত করে এবং গলা থেকে চেইন, কান ছিঁড়ে দুল নিয়ে যায়। পরে বারান্দার রুমে বসিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারার হুমকি দেয়। এরপরই তারা পেছনের দরজা খুলে পালান।
শরীফা বলেন, ভয়ে বাড়িতে যাই না। গেলেই এরা আসে। নাতি-নাতনিরা মারধরের ভয়ে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ছলিম বাড়ির হাফসা আক্তার জানান, বুধবার দুপুরে বাসার ভেতরে ছিলাম। খেতে বসবো এই সময়ে অজস্র লোকের ছুটে আসার শব্দ পাই। তারা আমাদের গেটে হামলা করে। অবস্থা খারাপ দেখে সন্ধ্যায় এক কাপড়ে বাড়ি থেকে সরে পড়ি। এরপর রাত ১০টায় আমাদের বাড়িতে ঢুকে হামলা, লুটপাট করা হয়। রাত ৩টায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। মোট ৪ বার আগুন দেয়া হয়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় দেয়া আগুনে আমার বিল্ডিংসহ সবকিছু শেষ হয়ে যায়। আমার ক্ষতি ১ কোটি টাকার ওপরে।
ছলিম বাড়ির মোহাম্মদ আলীর বাড়ি ছাড়াও গ্রামের পূর্বপাড়া, মধ্যপাড়া ও পশ্চিমপাড়ার মামুন মিয়া, আরিজ মাহমুদ, আব্দুস সালাম, জামাল মিয়া, চান্দু মিয়া, মো. ফারুক মিয়া, আউলাদ হোসেন, জাকির হোসেন, আলী হোসেন, ইকবাল হোসেনের বাড়িসহ আরও অনেক বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে আগুন দেয়া হয়। প্রত্যেকের ক্ষতি কোটি টাকার নিচে নয় বলে জানান ক্ষতিগ্রস্তরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাটাই গ্রামে ছলিম ও চান্দের গোষ্ঠীর বিরোধ চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। বিরোধের বিশেষ কোনো কারণ জানা যায়নি। পাল্টাপাল্টি একপক্ষ, আরেকপক্ষের লোকজনকে মারধর করা নিয়ে বিস্তৃত হয় ঘটনা। গত ৩১শে মার্চ ছলিমের গোষ্ঠীর তানিম নামে একজনকে মারধর করে চান্দের গোষ্ঠীর লোকজন। এ ঘটনায় ৪ঠা এপ্রিল তানিমের পিতা শাহেদ মিয়া বাদী হয়ে মামলা করেন। পাল্টা চান্দের গোষ্ঠীর তুহিনকে মারধর করা হয়। এরপর ১২ই মে ছলিমের গোষ্ঠীর আনোয়ার নামে একজনকে মারধর করে প্রতিপক্ষ। এ ঘটনায় ৩৮ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। এরপর চান্দের গোষ্ঠীর তকদীর মেম্বারের ছেলে দীপুকে মারধর করা হয়। মারধরের সর্বশেষ এ ঘটনার পরই উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। তিনদিন ধরে টেঁটা-বল্লম নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে। ১৪ই মে সংঘর্ষ চলাকালে মিয়াজুল হোসেন (৪৫) নামে একজন মারা যান। এরপরই নির্বিচারে প্রতিপক্ষের ঘরবাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
সূত্র জানিয়েছে, দুই গোষ্ঠীর বিরোধ মেটাতে আশপাশের এলাকার সরদার মাতব্বর এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা উদ্যোগ নিলেও তা ব্যর্থ হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সরদার জানান, চান্দের গোষ্ঠীর মোবারক মিয়ার অনাগ্রহের কারণে সালিশ বসে বিষয়টির মীমাংসা করা যায়নি। মিয়াজুলের মৃত্যুর ঘটনায় গত ১৭ই মে তার ছোট ভাই শাহাজুল বাদী হয়ে ১২৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোজাফফর হোসেন জানান, নাটাইয়ের ঘটনায় পক্ষে-বিপক্ষে ৩টি মামলা হয়েছে। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ টহল দিচ্ছে। হত্যা মামলায় ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পাঠকের মতামত
প্রতিবেশি হিসেবে অপর প্রতিবেশীকে রক্ষা করা সকলের কর্তব্য কিন্তু হচ্ছেটা কি? আফসোস বাঙালির জন্য। যখন বুঝ আসবে তখন অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আল্লাহ্ তুমি সকলকে হেদায়েত দাও। আমিন।
B Baria is a mentality poor District. This local people are very Illtreat Minded.