শেষের পাতা
৮ মাসে দুদকের আসামি ৯২৬
স্টাফ রিপোর্টার
২৯ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর গতি বেড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যক্রমে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে গত আট মাসে বিভিন্ন মামলায় ৯২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। সংস্থাটির জনসংযোগ বিভাগের তথ্য বলছে, এসব আসামির মধ্যে রয়েছেন জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধি। সূত্র জানায়, আট মাসে অনুসন্ধান, মামলা-চার্জশিট মিলিয়ে দুই হাজারেরও বেশিসংখ্যক ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যা এ গত কয়েক বছরের ক্ষেত্রে রেকর্ড। গত বছরের ডিসেম্বরে ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন দুদকের দায়িত্ব নেন। কমিশনে কাজের শুরুতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সব বড় রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়। মামলার পর অভিযোগপত্রও দাখিল করে কমিশন।
দুদকের নথি থেকে জানা যায়, জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে ২৯২টি অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু হয়। একই সময়ে ১৫৩টি অভিযোগের অনুসন্ধান শেষ করে মামলা করা হয়। এসব মামলায় ৪৭৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ১৪৪ জন, বেসরকারি চাকরিজীবী ১১৩ জন, রাজনীতিবিদ ৬০ জন, ব্যবসায়ী ৪৪ জন, জনপ্রতিনিধি ১১ জন এবং অন্যান্য ১০৫ জন। একই সময়ে ১১১টি মামলার তদন্ত শেষ করে বিচারিক আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। চার্জশিটে ৩৫২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ২০৩ জন, বেসরকারি চাকরিজীবী ৪৯ জন, ব্যবসায়ী ১৮ জন, রাজনীতিবিদ ৭ জন, জনপ্রতিনিধি ৯ জন ও অন্যান্য ক্যাটাগরির ৬৬ জন। দুদকের গত তিন মাসের মামলা ও চার্জশিটের আসামিদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ৩৪৭ জন, বেসরকারি চাকরিজীবী ১৬২ জন, ব্যবসায়ী ৬২ জন, রাজনীতিবিদ ৬৭ জন, জনপ্রতিনিধি ২০ জন এবং অন্যান্য ক্যাটাগরির ১৭৯ জন।
তথ্য বলছে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আট মাসে ৫২৫টি অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি। একই সময়ে অনুসন্ধান শেষ করে ২৯৭টি মামলা দায়ের ও মামলার তদন্ত শেষ করে ২৫৭টি চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। মামলাগুলোতে ৯২৬ জন এবং চার্জশিটে ১১৬৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। অর্থাৎ মামলা ও চার্জশিট মিলিয়ে মোট ২০৯৫ জনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৪৮ অভিযোগের অনুসন্ধান সম্পন্ন হয়। ওই সময়ে ৩২১টি মামলা এবং ৩৩১টি চার্জশিট দাখিল করা হয়। মামলায় ৬৩৮ জন আসামির মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ২৬৪ জন, বেসরকারি চাকরিজীবী ১৫০ জন, ব্যবসায়ী ৫৪ জন, রাজনীতিবিদ ১৫ জন, জনপ্রতিনিধি ১১ জন এবং অন্যান্য শ্রেণি-পেশার ১৪৪ জন রয়েছেন। একইসময়ে দাখিলকৃত চার্জশিটে ১৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ৭৫০ জন, বেসরকারি চাকরিজীবী ২২১ জন, ব্যবসায়ী ১০৩ জন, রাজনীতিবিদ ৬৮ জন, জনপ্রতিনিধি ১৪ জন এবং অন্যান্য শ্রেণি-পেশার ১৪৪।
দুদক জানায়, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সংস্থাটিতে অনুসন্ধানাধীন অভিযোগ ছিল ৪২৮৫টি। এর মধ্যে ৮৬১ অভিযোগের অনুসন্ধান সম্পন্ন হওয়ায় বাকি ৩ হাজার ৩৮৪টি অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান ছিল। চলতি বছরের তিন মাসে নতুন ২৯২টি অনুসন্ধান শুরু হয়। সবমিলিয়ে চলতি বছর দুদকের অনুসন্ধানাধীন অভিযোগের সংখ্যা ৩ হাজার ৬৭৬টি। এর মধ্যে ১৫৩টি অনুসন্ধান করে মামলা ও একটি অভিযোগের পরিসমাপ্তি হওয়ায় বর্তমানে ৩ হাজার ৭২২টি অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান।
দুদকের জালে যারা: গত বছরের ৫ই আগস্ট থেকে দুদক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী মোজাম্মেলক হকসহ সাবেক একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সিনিয়র সচিব, সচিব, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ইতিমধ্যে প্লট জালিয়াতির মামলার তদন্ত শেষ করে শেখ হাসিনাসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে।
দুদকের তথ্য বলছে, ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃৃত্বাধীন কমিশন গত বছরের ১৪ই ডিসেম্বর দায়িত্বভার গ্রহণ করে। পরদিন ১৫ই ডিসেম্বর ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের তথ্য গোপনসহ ৮৫ কোটি ৩২ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। এরপর ২৬শে ডিসেম্বর সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মোট ৬৪ কোটি ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৫৮৯ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৩২২১ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অপরাধে মামলা দায়ের করে। ১২ই ডিসেম্বর সাবেক বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম ও স্ত্রী দেওয়ান আলেয়ার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানির নামে ৬০টি ব্যাংক হিসাবে ৭২৫ কোটি ৭০ লাখ ৪২ হাজার ২৩২ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন এবং ৬৭ কোটি ৫৪ লাখ ২২ হাজার ২৫২ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা দায়ের করে।
এর আগে চলতি বছরের ১লা জানুয়ারি ১৪৬ কোটি ১৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ২৯টি ব্যাংকে ৬৬৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকার বেশি সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এরপর ১৬ই জানুয়ারি সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম ও তার স্ত্রী-সন্তানের বিরুদ্ধে ২৬টি ব্যাংক হিসাবে মোট ৩১৪ কোটি ৫৬ লাখ ২৬ হাজার ৩৭৪ টাকার অবৈধ লেনদেন এবং ৩১ কোটি ১৯ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮১ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তিনটি মামলা করে। গত ১৯শে জানুয়ারি সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবীর বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৮৪ লাখ ৪০ হাজার ৪৬ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৯টি ব্যাংক হিসাবে ১৫ কোটি ৩৮ লাখ ৫৭ হাজার ৮২৫ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে মামলা করে। এ ছাড়া তার স্ত্রী তৌফিকা আহমেদের বিরুদ্ধে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৭৩ হাজার ৭৩৮ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ব্যাংক হিসাবে ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৬২ হাজার ৩৭ টাকা এবং ২২ হাজার ২৮০ মার্কিন ডলার লেনদেনের অভিযোগে একটি মামলা করে। গত ২১শে জানুয়ারি সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের ১২ কোটি ৮১ লাখ ১৪ হাজার ৩৮৯ টাকার সম্পদ অর্জন এবং ৯টি ব্যাংক হিসাবে ৩০ কোটি ৪৫ লাখ ৩২ হাজার ৮৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে মামলা করে। গত ২২শে জানুয়ারি সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৭ কোটি ৮০ লাখ ২০ হাজার ৯৩৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৩৫টি ব্যাংক হিসাবে ১৩৯ কোটি ৭৪ লাখ ৯৮ হাজার ১১৭ টাকা লেনদেনের অভিযোগে মামলা করে। গত ১০ই ফেব্রুয়ারি প্রায় ৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ব্যাংকে প্রায় ৬০ কোটি টাকার সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগে সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং তার স্বামীর বিরুদ্ধে দুই মামলা করে দুদক।
দুদকের কার্যক্রমের বিষয়ে সংস্থাটির উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আট মাসে বিভিন্ন মামলায় ৯২৬ জন আসামি হয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধি। দুদকের কাজকে গতিশীল করতে সবার সহযোগিতা দরকার। কমিশনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হয়েছে, দুর্নীতি করলেই কোনো ছাড় নয়। সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে।