অনলাইন
ট্রাম্প ও আল-শারা বৈঠক
মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন
মানবজমিন ডেস্ক
(৭ ঘন্টা আগে) ১৫ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১০:৪১ পূর্বাহ্ন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে পরিচিত বর্তমানে সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমদ আল-শারার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। এই বৈঠকটিকে বিশ্লেষকরা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে দেখছেন। আলোচিত এই বৈঠকের অন্যতম চমক ছিল সিরিয়ার বর্তমান অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমদ আল-শারার অতীত পরিচয়। তিনি এক সময়ে ‘আবু মোহাম্মদ আল-জাওলানি’ নামে পরিচিত ছিলেন। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। তিনি আল কায়েদা ও আইএসের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ছিলেন। ২০১৩ সালে জাতিসংঘের সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি তাকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জন্য’ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক কমিটি তাকে আল কায়েদা ও আইসিসের জন্য অস্ত্র কেনা, সরবরাহ ও হস্তান্তরের দায়ে অভিযুক্ত করে। একই সঙ্গে এই দুটি সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে সদস্য সংগ্রহের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। তিনি সরাসরি আল কায়েদার তখনকার প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরি ও পরে আইসিস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির সঙ্গে সরাসরি সমন্বয় করতেন।
২০১১ সালে সিরিয়ায় অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ শাসকগোষ্ঠীকে সমর্থন দেয় রাশিয়া ও ইরান। এ সময় স্থানীয়দের নিয়ে আল কায়েদা ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া নামে একটি ফ্রন্ট স্থাপনের জন্য আল জাওলানিকে নির্দেশনা দেন আবু বকর আল বাগদাদি। ২০১২ সালে আল জাওলানি প্রতিষ্ঠা করেন আল নুসরা ফ্রন্ট। অফিসিয়ালি এর পরিচয় ছিল জাবাত ফাতাহ আল শাম। পরে এটি সিরিয়ায় আল কায়েদার শাখা হয়ে ওঠে। ততক্ষণে সিরিয়ায় ২০১১ সালে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিক্ষোভ বিপ্লবে রূপ নেয়। আল শাম গোষ্ঠীই ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে সিরিয়ায় ব্যাপক সামরিক অভিযান চালিয়ে বাশার আল-আসাদের সরকারকে উৎখাত করে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে আল-জাওলানি নিজেকে আহমদ আল-শারা নামে পরিচিত করে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ট্রাম্পের বৈঠক: নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও স্বীকৃতি
আল শারার সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ১৯৭৯ সাল থেকে সিরিয়ার উপর আরোপিত সকল মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কূটনীতির অবস্থানকে আমূল বদলে দেয়। হোয়াইট হাউস থেকে বিবৃতিতে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার নতুন সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, আল-শারার নেতৃত্বে সিরিয়া শান্তির একটি নতুন সুযোগ পেতে পারে। এই বৈঠক সম্ভব হয়েছে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের মধ্যস্থতায়। তিনিই ট্রাম্প ও আল-শারার বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। সৌদি আরবের সক্রিয় ভূমিকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন মধ্যপ্রাচ্যে ইরানবিরোধী একটি নতুন জোট গঠনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বৈঠকের সময় ভিডিও কলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান অংশ নেন, যা এ অঞ্চলে নতুন একটি শক্তিশালী অক্ষের জন্ম দিচ্ছে।
উপসাগরীয় অনেক রাষ্ট্রও নতুন সিরিয়ান সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। অন্যদিকে, ইসরাইল এই বৈঠক এবং সিরিয়ার নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে সাবধান করে বলেছে, জাওলানির অতীতের সন্ত্রাসী ভূমিকার কারণে এই সরকারকে বৈধতা দেয়া উচিত নয়। সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ট্রাম্পের ঘোষণা ও বৈঠককে ‘একটি যুগান্তকারী মোড়’ হিসেবে অভিহিত করেছে। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার আমাদের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে- একটি স্বনির্ভর, শান্তিপূর্ণ ও পুনর্গঠিত সিরিয়ার দিকে।
আহমদ আল-শারার অতীত যত বিতর্কিতই হোক না কেন, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাকে স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন ধারা তৈরি করতে চলেছে। এই পরিবর্তন কেবল সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই নয়, গোটা অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্যকে নাড়িয়ে দিয়েছে।