ঢাকা, ১৫ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৬ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

বাংলারজমিন

চাঁপাইনবাবগঞ্জ খাদ্য বিভাগে দুর্নীতির সিন্ডিকেটে দুই কর্মকর্তা

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি
১৫ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার
mzamin

চাঁপাইনবাবগঞ্জ খাদ্য বিভাগে গড়ে উঠেছিল দুর্নীতির এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সদ্য বদলি করা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জান মোহাম্মদ তার অধীনস্থ খাদ্য পরিদর্শক ও সদর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাকিলা নাসরিনকে নিয়ে দুর্নীতির এই জুটি গড়েছিলেন। তাদের দুর্নীতির চিত্র সামনে আসার পর এ জুটি ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছে খাদ্য বিভাগ। বদলি করা হয়েছে মোহাম্মদকে। আর ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে সাকিলার কাছে।
কিন্তু নতুন কর্মস্থলে যাননি মোহাম্মদ। তিনি সদর উপজেলার আমনুরা খাদ্যগুদামে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েবের চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে বাধা দেয়ায় খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও খাদ্য পরিদর্শক রেশমা ইয়াসমিনকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। রেশমা এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এ নিয়ে একটি কমিটি করা হলে প্রাথমিক তদন্তেই ঘটনার সত্যতা মিলেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১লা মে খাদ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদকে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলায় বদলি করেন। একই আদেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আতাউর রহমানকে সদরে বদলি করা হয়। কিন্তু আতাউরের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকেন মোহাম্মদ। ফলে গত ৭ই মে বিকালে অফিসে গিয়ে দায়িত্ব বুঝে নেন আতাউর। তিনিই এখন দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু এখনও পিরোজপুর যাননি মোহাম্মদ। সোমবার সকালেও তিনি সদর কার্যালয়ের সামনে বসে ছিলেন।

এদিকে মোহাম্মদ সদরের অধীনস্থ আমনুরা খাদ্যগুদামের পেয়িং অফিসার ছিলেন। ৭ই মে আতাউর দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন তাকে পেয়িং অফিসার করা হয়। কিন্তু ৯ই মে পেয়িং অফিসার হিসেবে গুদামে গিয়ে নথিপত্র নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন মোহাম্মদ। এতে গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেশমা তাকে বাধা দেন। তখন রাগান্বিত হয়ে এই নারী কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করেন মোহাম্মদ। সেদিনই লিখিতভাবে বিষয়টি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহন আহমেদকে জানান তিনি।
ঘটনার পর জেলার ভোলাহাট উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জান্নাতুন ফেরদৌসীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে দেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহন আহমেদ। তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে মোহাম্মদের বদলির পরও সংরক্ষিত খাদ্যগুদামে তার অবৈধভাবে প্রবেশ, অফিসের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ও রেশমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

সমপ্রতি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহন আহমেদ জেলা শহরের বিভিন্ন ওএমএস’র ডিলারদের দোকান পরিদর্শন করেন। তখন তিনি দেখতে পান, গুদাম থেকে সরবরাহ করা চালের বস্তায় ‘বিতরণকৃত’ লেখা স্টেনসিল মার্ক দেয়া হয়নি। অথচ গুদাম থেকে খাদ্যশস্যসহ বস্তা বের করার সময় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নামসহ এই স্টেনসিল দেয়া বাধ্যতামূলক। এই স্টেনসিল দেয়ার জন্য শ্রমিক বিল বরাদ্দ থাকে। স্টেনসিল না দেয়া হলেও ৮৫ হাজার টাকা বিল তুলে নেয়া হয়। এ নিয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সাকিলার কাছে ব্যাখা তলব করেন। শ্রমিক বিল তুললেও কেন বস্তায় স্টেনসিল দেননি তার জবাব দিতে বলা হয়েছে তাকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্টেনসিল না দিলেও প্রতিমাসেই ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা শ্রমিক বিল প্রস্তুত করেন সাকিলা। আর পেয়িং কর্মকর্তা হিসেবে এই বিল অনুমোদন করতেন জান মোহাম্মদ। পরে বিলের টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিতেন দু’জনে। সদর গুদামে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন ধান-চাল কেনা হয়। বেশ কয়েকজন মিলার জানিয়েছেন, জান মোহাম্মদের কথা বলে টনপ্রতি ২০০ টাকা আদায় করেন সাকিলা নাসরিন। একইভাবে বস্তা সরবরাহকারী ঠিকাদারদের কাছ থেকেও টাকা আদায় করেন তিনি।
খাদ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি ডিও ছাড়ের সময় মোহাম্মদ বরাদ্দপ্রাপ্তদের কাছ থেকে ২০০ টাকা নিতেন। একইভাবে চাল ছাড়ের সময় ২০০ টাকা নেন সাকিলা। আবার গভর্নমেন্ট শর্টেজ (জিএস) দেখিয়েও সদর গুদাম থেকে সরকারি ধান-চাল আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে দু’জনের বিরুদ্ধে।

বিষয়ে কথা বলতে সাকিলাকে ফোন করা হয়। পরিচয় দেয়ার পর তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে ফোন ধরেননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাকিলা ও মোহাম্মদের এমন দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। মোহাম্মদ এর আগে শিবগঞ্জে খাদ্য নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তখন তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছিল। ২০২৩ সালে শিবগঞ্জে ২১ হাজার ৪৬১টি খাদ্যবান্ধব কার্ডের ডাটাবেজ এন্ট্রি বাবদ ১ লাখ ৭ হাজার ৩০৫ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছিল। কিন্তু তিনি পার পেয়ে যান।
অভিযোগগুলোর বিষয়ে মোহাম্মদ বলেন, আমার চাকরির বয়স ৩৬ বছর। অভিযোগ উঠতেই পারে। যে কেউ মিথ্যা অভিযোগ দিতে পারে। বাস্তবে সত্যতা কতটুকু সেটা বিষয়। এখন রেশমা ইয়াসমিন আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। আমিও সঠিক তদন্ত চাই।

জেলার ভারপ্রাপ্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহন আহমেদ বলেন, মোহাম্মদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ থাকলেও কেন এতদিন তিনি শাস্তি পাননি তা জানি না। তবে আমি আসার পর ইয়াসমিনের লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তারপর কমিটি করে তদন্ত করেছি। রিপোর্টও পেয়েছি। এতে ঘটনার সত্যতা উঠে এসেছে। আমি এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠাব। তারা ব্যবস্থা নেবেন বলে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। সাকিলার সঙ্গে জান মোহাম্মদের দুর্নীতির সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের বিষয়গুলো আমি জানি না। তবে সমপ্রতি আমি শ্রমিক বিল তুলে নিলেও স্টেনসিল না দেয়ার একটা অনিয়ম পেয়েছি। তার প্রেক্ষিতে ব্যাখা তলব করেছি।

বাংলারজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বাংলারজমিন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status