ঢাকা, ৩ মে ২০২৫, শনিবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৪ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

অনলাইন

ভারত মহাসাগরের বুকে আরেকটি অস্থির বছর

মানবজমিন ডিজিটাল

(১১ ঘন্টা আগে) ২ মে ২০২৫, শুক্রবার, ১২:১৪ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:২৩ অপরাহ্ন

mzamin

গত ১২ মাসে ভারত মহাসাগর অঞ্চলের পরিস্থিতি আবারও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। হুথি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে ভারত মহাসাগরে যাতায়াতকারী জাহাজগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের লক্ষ্যবস্তু হলো ইসরায়েল এবং যারা ইসরায়েলকে সমর্থন করে তাদের জাহাজ। তবুও কিছু আক্রমণ ভিন্ন বলে মনে হয়েছে। হুথি বিদ্রোহীদের কাছে বিপুল পরিমাণে বিভিন্ন ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন রয়েছে।

ভারত মহাসাগর অঞ্চলের বাস্তব পরিস্থিতি এই সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে যে, বহিরাগত মিত্রদের কাছ থেকে হুথি বিদ্রোহীদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ আসছে। হুথিদের হুমকিকে এখন কীভাবে দেখা উচিত? 

বৃটিশ ভাইস অ্যাডমিরাল হোরাশিও নেলসন বলে গেছেন, ‘একটি জাহাজের দুর্গের (যেমন, একটি শক্তিশালী নৌ যুদ্ধজাহাজ))সাথে যুদ্ধ করা বোকামি।’

এই প্রবাদের মাধ্যমে তিনি স্থল ও সমুদ্রভিত্তিক বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের অসমতা বর্ণনা করেছেন। আজ ভারত মহাসাগর এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের সংকীর্ণ সমুদ্র অঞ্চলকে নৌ বাহিনীর আরও সাবধানতার সাথে বিবেচনা করা উচিত। কারণ এরকম অনেক জায়গায় শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। এই টালমাটাল পরিস্থিতির জেরে বাণিজ্য ব্যাহত হতে পারে। অন্যদিকে রুট পুনর্বিন্যাস করতে সময় লাগে এবং এর সাথে বিপুল পরিমাণ খরচও জড়িত। সেইসঙ্গে তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়বহুল ক্ষেপণাস্ত্র এবং সশস্ত্র ড্রোনকে মোকাবেলা করতে ব্যয়বহুল ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান  ব্যবহার করা হচ্ছে। হুথিদের বোমা হামলার হুমকি বাণিজ্য ব্যাহত করছে এবং নৌবাহিনীকে লোহিত সাগর থেকে আরও দূরে অভিযান চালাতে বা সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে যেতে বাধ্য করছে। 

মার্কিন নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর হামলা সত্ত্বেও স্থলভাগে হুথিদের ‘প্রাণঘাতী’ হামলার  ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে হ্রাস পায়নি।ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতি বহাল থাকলে তারা হয়তো কিছুটা পিছিয়ে আসতে পারে, কিন্তু প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়।

ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীন এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। লোহিত সাগরের পরিস্থিতি থেকে একটি উল্লেখযোগ্য ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) ‘সক্রিয় প্রতিরক্ষা’ এবং যৌথ বহুমাত্রিক অপারেশনাল কাঠামো দ্বারা নির্মিত ‘দুর্গ’ কতটা বড় হতে পারে। পিএলএ নৌবাহিনীর (PLAN's) উল্লেখযোগ্য সামুদ্রিক ক্ষেত্র সম্পর্কে সচেতনতা এবং অস্ত্র ও সরবরাহ ব্যবস্থার মজুদের কারণে এটি খুব শীঘ্রই পরিবর্তন হবে না। পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরের বাইরে নিয়মিত এবং উন্নত অস্ত্র ও সরবরাহ মজুদের কারণে চীনের ক্রমবর্ধমান ভূ-কৌশলগত প্রভাব সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের কাছাকাছি একটি শক্তিশালী পিএলএ নৌবাহিনীর সাম্প্রতিক সমুদ্রযাত্রা যা ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেছে, একটি সংকেত ছিল। যদিও নৌবহরটি সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ার একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে অস্ত্র অনুশীলন পরিচালনা করেছিল, ট্রানজিট প্যাসেজের সময় তা করা জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সংক্রান্ত কনভেনশন লঙ্ঘন করে না। 
তবে, এটি পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরের জন্য চীনের দাবিকৃত নিয়ম লঙ্ঘন করে।

মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তনের পর নতুন চুক্তিগুলো বেইজিংয়ের ওপর আরও বেশি প্রভাব ফেলেছে। পাকিস্তান, মিয়ানমার, বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশগুলো চীনের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।  আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।  সাবমেরিন নৌঘাঁটি বিএনএস শেখ হাসিনা- এর নাম পরিবর্তন করে শীঘ্রই নিকটবর্তী শহরের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় বিএনএস পেকুয়া। শীঘ্রই এই নৌঘাঁটি সরবরাহ এবং মেরামতের জন্য চীনা সাবমেরিনগুলোকে আতিথেয়তা দিতে পারে। 

ইতিমধ্যে ভারত এই ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলোতে খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করছে। ভারত দ্বীপ ও উপকূলীয় দেশগুলোর সাথে অংশীদারিত্ব অব্যাহত রেখেছে এবং তাদের সামুদ্রিক পরিষেবাগুলোকে জাহাজ স্থানান্তর, প্রশিক্ষণ এবং টহলদারি   সহায়তার মাধ্যমে অব্যাহত রেখেছে। চীনের বিপরীতে বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং মালদ্বীপ সাম্প্রতিক দশকগুলোতে গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। যা ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক মূল্য বহন করে। 

মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে এমভি রুয়েনের বিরুদ্ধে ভারতের জোরালো পদক্ষেপ দেশের নৌ বাহিনীর  ঝুঁকি নেয়ার আগ্রহের দিকে ইঙ্গিত করে। জাহাজটি ৩৫ জন জলদস্যু কর্তৃক অপহৃত হয়েছিল এবং ১৭ জন ক্রু সদস্যকে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল।

ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়া তার কৌশলগত সম্পর্ক উন্নীত করতে প্রস্তুত। এর জেরে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে সামুদ্রিক সহযোগিতা দ্বিপাক্ষিক ও ত্রিপক্ষীয়ভাবে বৃদ্ধি পাবে। ২০২৪ সালে কিছু সময়ের জন্য মনে হয়েছিল যে ডিয়েগো গার্সিয়ার উপর মরিশাসের সার্বভৌমত্ব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডের ইজারার ধারাবাহিকতা নিয়ে সমস্যাগুলোর  সাধারণত সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু পোর্ট লুইস, মরিশাস এবং ওয়াশিংটনের নতুন সরকার এবং লন্ডনের নতুন চাপের ফলে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে  আংশিকভাবে। কারণ মালদ্বীপ থেকে দক্ষিণে দ্বীপপুঞ্জে চীনা বিনিয়োগ এবং প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কা রয়েছে। ডিয়েগো গার্সিয়ার ওপর মার্কিন বোমারু বিমান ঘাঁটিটি একটি সমস্যা হিসেবেই থেকে যেতে পারে।

নৌবাহিনী কর্তৃক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অবৈধ চালান আটক করা সত্ত্বেও ভারত মহাসাগরে মাদক পাচার অব্যাহত রয়েছে। এই অঞ্চলে ভারতসহ অনেক দেশ কেবল গন্তব্যস্থলই নয়, বাণিজ্যের উৎসও বটে। পাকিস্তান রোমানিয়া থেকে দুটি বৃহৎ অফশোর টহল জাহাজ অর্জন করেছে এবং চীনের সাথে ‘ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহযোগিতার’ অংশ হিসেবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আটটি চীনা ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিন (SSK) পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি এগিয়েছে, দেশটি আকাশ থেকে নিক্ষেপযোগ্য এবং জাহাজ থেকে নিক্ষেপযোগ্য অ্যান্টি-শিপ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে বলে দাবি করেছে।

২০২৪ সালে ভারত একাধিক জাহাজ কমিশন করেছিল। যার মধ্যে ছিল দুটি গাইডেড-মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, দুটি গাইডেড-মিসাইল ফ্রিগেট, একটি পারমাণবিক-চালিত ব্যালিস্টিক-মিসাইল সাবমেরিন এবং একটি এসএসকে। সেইসাথে একটি হাইড্রোগ্রাফিক জাহাজ এবং আরও বেশ কয়েকটি জাহাজ নামানো হয়েছিল। ভারত সরকার বেশ কয়েকটি পারমাণবিক শক্তিচালিত আক্রমণাত্মক সাবমেরিনের জন্যও অস্থায়ী অনুমোদন দিয়েছে। কোয়াডে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চতুর্ভুজ নিরাপত্তা সংলাপ অনেকদূর এগিয়েছে। বেশ কয়েকটি বৈঠকের শেষে মন্ত্রী ও নেতাদের যৌথ বিবৃতিতে সমুদ্র বাণিজ্যের নিরাপত্তার জন্য সামুদ্রিক উদ্যোগের উপর জোর দেয়া হয়েছে, সমুদ্রে  অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরা এবং সামুদ্রিক ক্ষেত্র সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট  ডনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের পরের দিন, ২০২৫ সালের ২১ জানুয়ারি মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকটি বিশেষভাবে জোরালো ছিল এবং কোয়াডের মূল নিরাপত্তা সুবিধাগুলো সম্পর্কে  আলোচনা করা হয়।

যদি ২০২৪ সাল ভারত মহাসাগর অঞ্চলে একটি  ভয়াবহ বছর হয়, তাহলে ২০২৫ এবং তার পরের বছগুলোতে সেই ভয়াবহতা আটকাতে প্রয়োজন পরিকল্পনা, প্রস্তুতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতা। তবেই একটি মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিক গঠন করা সম্ভব।

সূত্র : ইউএস ন্যাভাল  ইনস্টিটিউট

অনলাইন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

অনলাইন সর্বাধিক পঠিত

‘দ্য উইক’ ম্যাগাজিনে তারেক রহমানকে নিয়ে কাভার স্টোরি/ ‘নিয়তির সন্তান’

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status