অনলাইন
জ্বালানি বিভাগের নতুন নির্দেশনায় বিতরণ কোম্পানি তথা পেট্রোবাংলায় স্থবিরতা নামার শঙ্কা
স্টাফ রিপোর্টার
(১১ ঘন্টা আগে) ২৫ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবার, ৬:৩৬ অপরাহ্ন
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের নতুন নির্দেশনার ফলে বিতরণ কোম্পানি তথা পেট্রোবাংলায় এক ধরনের স্থবিরতা নেমে আসার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কারের মূল লক্ষ্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। সে লক্ষ্যেই দৃশ্যমান হচ্ছে নানান উদ্যোগ। কিন্তু সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ঠিক উল্টো পথে হাটছে বলছেন তারা। বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা ক্ষমতাকে আরও কুক্ষিগত করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে ইস্যু করা একাধিক পত্রের প্রেক্ষিতে এমন মন্তব্য করেছেন জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টরা। জ্বালানি বিভাগের ইস্যু করা নতুন আদেশের ফলে বিতরণ কোম্পানিগুলোর ক্ষমতা শূন্যে নামিয়ে আনা হয়েছে। মূলত তাদের আর কোন ক্ষমতাই থাকছে না।
সর্বশেষ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ২১শে এপ্রিল ইস্যু করা এক চিঠিতে শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে পুর্বানুমতি গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ১৬ই এপ্রিল সভার রেফারেন্স দিয়ে লেখা চিঠিতে, শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এসব নির্দেশনায় জরুরি প্রয়োজনে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে কেস টু কেস ভিত্তিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পুর্বানুমতি সাপেক্ষে গ্যাস সংযোগ প্রদান করা যেতে পারে। বিষয়টি সকল গ্যাস বিপণন ও বিতরণ কোম্পানিকে অবহিত করার জন্য পেট্রোবাংলা নির্দেশ দেয়া হয়।
এর আগে ১৬ই এপ্রিল উপসচিব রুবায়েত খান ৫ দফা নির্দেশনা দিয়ে একটি চিঠি ইস্যু করেছেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, গ্যাস সংযোগ প্রদানের আবেদন বিবেচনার ক্ষেত্রে আবেদনসমুহকে নতুন সংযোগ, লোডবৃদ্ধি এবং প্রতিশ্রুত-এই ৩ ভাগে বিভক্ত করতে হবে। তারপর গ্যাস বিতরণ কোম্পানিসমূহ কর্তৃক গ্যাসের পর্যাপ্ততা বিবেচনায় নিয়ে একটি অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করে জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলায় প্রেরণ করতে হবে। নতুন সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রাহকের গ্যাস প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
নতুন সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রধান উদ্দেশ্যে হবে রাজস্ব বৃদ্ধি করা, এ ক্ষেত্রে প্রতিটি সংযোগের অর্থনৈতিক প্রভাব পর্যালোচনা করতে হবে। শিল্প শ্রেণিতে নতুন সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল এবং রপ্তানিমুখী শিল্পকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এরূপ নতুন সংযোগ অথবা লোডবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যে অতিরিক্ত গ্যাস বরাদ্দ প্রয়োজন হবে তা নিরূপণ করে যথাসময়ে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
প্রথম দফার চিঠিতে বিষয়টি কিছুটা ধোঁয়াশা থাকলেও পরের চিঠিতে গ্যাস সংযোগের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পুর্বানুমতির বিষয়টি স্পষ্ট করে দেয়া হয়। আর এখানেই আপত্তিটা উঠতে শুরু করেছে। সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে বিতরণ কোম্পানির কাজটি কি? বোর্ডগুলোতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব থেকে শুরু করে অনেক সিনিয়র সচিব রয়েছেন। রয়েছেন একাধিক অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিব। তারা কি তাহলে শুধু মন্ত্রণালয়ে প্রেসক্রিপশন অনুমোদন দিবেন!
আবার প্রথম দফায় ইস্যু করা চিঠির পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে, নতুন সংযোগ অথবা লোডবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যে অতিরিক্ত গ্যাস বরাদ্দ প্রয়োজন হবে, তা নিরূপণ করে যথাসময়ে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিষয়টি যেন এমন-কাল তিতাস কিংবা কর্নফূলী নতুন গ্যাস সংযোগ অনুমোদন দিবে, পরদিন থেকে পেট্রোবাংলা এলএনজি আমদানি বাড়িয়ে দিবে। যাতে বাড়তি গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যে, মনে হচ্ছে দেশে কোন গ্যাস সংকট নেই। বাড়তি লোড অনুমোদন হলে সেটুকু চাহিদা পেট্রোবাংলা সামাধান করলেই মিটে যাবে। কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, (পেট্রোবাংলার হিসাব মতে) দেশের প্রতিশ্রুত (ইতোমধ্যে অনুমোদিত) গ্রাহকদের গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৫৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট, আর সরবরাহ দেয়া হচ্ছে মাত্র ২৭০০ মিলিয়নের মতো। তারা বলছেন, অর্ধেকের বেশি এখনও ঘাটতি রয়েছে। প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের চাহিদা পুরণ করতে হলে দৈনিক আরও ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা দরকার। যদিও পেট্রোবাংলা মনে করে গ্যাসের প্রকৃত চাহিদা ৪০০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। সে হিসাব ধরলেও ঘাটতি প্রায় ১৩০০ মিলিয়ন। পুর্নসক্ষমতায় এলএনজি আমদানি করলে সরবরাহ বাড়বে মাত্র ৫০ মিলিয়নের মতো।
বিতরণ কোম্পানিগুলোর সূত্র জানা গেছে, মূলত মন্ত্রণালয়ে মধ্যমসারির কিছু কর্মকর্তা প্রতিনিয়ত তদবিরে ব্যস্ত। অনেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুরুর দিকে কাজ করে দিলেও এখন বোর্ডের দোহাই দিয়ে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এতেই ক্ষেপেছেন তদবিরবাজরা। তারা বোর্ডগুলোকে দেখে নেয়ার হুমকি শুনিয়েছিলেন। নতুন আদেশের পেছনে ওই তদবিরবাজদের ভূমিকা থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও এই ক্ষমতার চর্চা জারি রেখেছিল মন্ত্রণালয়। তারা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে সংযোগ বাণিজ্য করতো। বিতরণ কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাগজের পুতুল বানিয়ে রাখা হয়েছিল।
সরকার পরিবর্তনের পর সেই ধারায় কিছুটা ছেদ দেখা যায়। বিশেষ করে তিতাস বোর্ড ব্যবস্থাপনা পরিচালককে কিছু ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়। সময়ের ব্যবধানে মন্ত্রণালয় আবার জেকে বসতে শুরু করেছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলাদের মতোই সেই ধারা চালু হওয়ায় অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, তাহলে কিসের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। এটাকে তো কুক্ষিগত করে রাখা ছাড়া কিছুই বলা যায় না।
আগের সরকার যে প্রবিধানমালার দোহাই দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম নির্বাহী আদেশে নির্ধারণ করতো। সেগুলো এখনও ঝুলিয়ে রাখার পথেই হাটছে। ৮ মাসেও শেষ করা যায়নি। এক্ষেত্রে উপদেষ্টাকে অন্ধকারে রাখছেন কিছু সুবিধাবাদী আমলারা। নতুন নির্দেশনার ফলে বিতরণ কোম্পানি তথা পেট্রোবাংলায় এক ধরনের স্থবিরতা নেমে আসার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেছেন, নির্বাহী আদেশে এই কাজগুলো করা সমীচীন হচ্ছে না। কর্তৃত্বগুলো স্বচ্ছ হওয়া দরকার। কোম্পানিগুলোর বোর্ড সংশ্লিষ্ট ও দক্ষ লোক দিয়ে গঠন করা দরকার। আমলাদের দ্বারা বোর্ড গঠন করা মুর্খতা ছাড়া আরও কিছুই না। আইন অনুযায়ী সকল ধরণের জ্বালানির দাম নির্ধারণের এখতিয়ার দেয়া হয়েছে বিইআরসির হাতে। মন্ত্রণালয় সম্পুর্ণ বেআইনিভাবে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করে যাচ্ছে। আইনে রেগুলেশন তৈরির এখতিয়ার দেয়া হয়েছে বিইআরসিকে। সেখানে মতামত দেয়ার কথা মন্ত্রণালয়ের। তারা মতামত না দিয়ে আটকে রেখে নিজেই তেলের দাম নির্ধারণ করে যাচ্ছে। আমরা শিগগিরই আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।