বাংলারজমিন
নতুন জীবনে এসিডদগ্ধ মনি
স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর থেকে
২২ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার
রংপুরের আলোচিত সংগ্রামী এসিড দগ্ধ মাসুদা আক্তার মনি। ছোট্ট একটি জীবনে করতে হয়েছে কঠিন যুদ্ধ। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে জীবনের প্রথম অধ্যায় শেষ করেছেন। সম্প্রতি বিয়ে করে নতুন জীবনে পা রেখেছেন। তার সংগ্রামী জীবন কাহিনী যেন নাটক-সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। নগরীর বাবু খাঁ এলাকায় বেড়ে ওঠা মনি ছোটবেলায়ই হারিয়েছেন বাবাকে। অভাব- অনটনের সংসারে মায়ের আদর-যত্নে বড় হয়ে ওঠে। মনি ছিলেন সুন্দরী। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে তার ওপর চোখ পড়ে এলাকার বখাটেদের। তারা মনিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার পথে প্রায়ই প্রেম নিবেদন করতো। কিন্তু তার জীবনের লক্ষ্য ছিল শিক্ষা অর্জন করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তাই সে পাত্তা না দেয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বখাটেরা। ২০১২ সালের ১৩ই আগস্ট স্কুলে যাওয়ার পথে স্থানীয় বখাটে আরিফুলের নেতৃত্বে এক দল কিশোর গ্যাং তার চোখে, মুখে ও শরীরে এসিড নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায়। পরে তার চিৎকারে এলাকাবাসী ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। এ দুঃসংবাদ পেয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন মনির মা। সংবাদটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হয় মানবজমিন-এ। ঘটনাটি তৎকালীন রংপুর শহরসহ সারা দেশে আলোচিত হয়ে ওঠে। অন্যায়কারী বখাটেদের বিরুদ্ধে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। বিভিন্ন সামাজিক পেশার মানুষজন হয়ে ওঠেন সোচ্চার। এসিডদগ্ধ মনির পাশে দাঁড়ায় রংপুর জেলা প্রশাসন, মানবাধিকার সংগঠন ইউনিটি ফর ইউনিভার্স হিউম্যান রাইটস অব বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন রংপুর বিভাগীয় কমিটি। এ ঘটনায় মামলা হলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। গ্রেপ্তার করা হয় আসামিদের। মানবাধিকার সংগঠনের মোজাক্কের হোসেন মঞ্জু এড. সিরাজুল কবীর, এড. মতিয়ার রহমান, সাংবাদিক মেরিনা লাভলী মামলা পরিচালনায় সহযোগিতা করেন। মামলায় আসামি আরিফুলের ফাঁসি ও আলাল-দুলাল নামে দুইজনের যাবজ্জীবনের রায় প্রদান করা হয়। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার পর দগ্ধ মনিকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে নেয়া হয়। কিছুটা সুস্থ হয়ে মনি বীভৎস চেহারা ও অমানুষিক যন্ত্রণায় হারিয়ে ফেলে বেঁচে থাকার আগ্রহ। এ সময় পাশে থাকা সকলের উৎসাহে নিজের মনোবল শক্ত করে শুরু করে নতুন করে বেঁচে থাকার যুদ্ধ-সংগ্রাম। মেধাবী মনি’র পড়াশোনার দুর্বলতা দেখে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্যোগ নেয় মানবাধিকার সংগঠনের কামরুজ্জামান সরকার রুবেল। তাকে সহযোগিতা করেন আব্দুল গফুর, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার, রেজাসহ ইউনিটি ফর হিউম্যান রাইটসের সকল সদ্যস। ২০১৬ সালে ভারতে চোখের চিকিৎসা করে ফিরে এসে মনি এসএসসি, ২০১৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব বিভাগে অনার্স সম্পন্ন করে মাস্টার্স পরীক্ষা দেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তার বিভাগের সহপাঠী গাইবান্ধার আরেক সংগ্রামী মাইদুল ইসলামের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। জীবনযুদ্ধের দুই সৈনিক একে-অপরকে পাশাপাশি থাকার স্বপ্ন বুনেন। তাদের চার হাত এক করে দেয় মানবাধিকার সংগঠনের সদস্যরা। জাঁকজমক নয়, সাদামাটাভাবে ইসলামী শরীয়াহ্ মোতাবেক বিয়ে দিয়ে তাদের নামে ব্যাংকে টাকা এফডিআর করে দিয়ে নতুন জীবন শুরুর অনুপ্রেরণা জোগায়। মনির উৎসাহ, মনোবল, সংগ্রামী জীবনের কার্যক্রম সকলকে চমকে দিয়েছে। পেয়েছেন একাধিক সরকারি-বেসরকারি সম্মাননা।