ঢাকা, ২১ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার, ৮ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২১ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

সরজমিন পঙ্গু হাসপাতাল

গুলিতে হাত-পা হারিয়ে স্বপ্ন ভেঙেছে ওদের

ফাহিমা আক্তার সুমি
২৮ আগস্ট ২০২৪, বুধবার
mzamin

চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ আতিকুল ইসলামের। গুলিবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছেন   হাসপাতালের বেডে। ৫ই আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেমে গুলিবিদ্ধ হন আতিকুল। বর্তমানে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) ক্যাজুয়ালিটি-২ এর জি-৩১ নম্বর বেডে ভর্তি রয়েছেন তিনি। জীবন বাঁচিয়ে রাখতে কাটতে হয়েছে তার ক্ষতিগ্রস্ত হাত। আতিকুল একটি ফ্যাশন হাউজের বিক্রয়কর্মী ছিলেন। স্বপ্ন ছিল বিদেশ যাওয়ার। কিন্তু হাত কাটার পর সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কিনা তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। আবার কখনো কখনো দুশ্চিন্তার ছাপ সরিয়ে আন্দোলন সফল হওয়ায় আতিকুলের মুখে ফুটে উঠছে হাসি। তিনি মানবজমিনকে বলেন, নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। এরপর একটি ফ্যাশন হাউজের বিক্রয়কর্মী ছিলাম। ৫ই আগস্ট উত্তরা আজমপুরে আন্দোলনে নেমে গুলিবিদ্ধ হই। বিকাল ৪টার দিকে ঘটনাটি ঘটে। ডান হাতের কনুইয়ের উপরে গুলি লাগে। হাতের রক্তনালী ছিঁড়ে গেছে। গুলি হাতের ভেতর থেকে যায়। এর পর প্রথমে হৃদরোগ হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে। তিনি বলেন, ৭ই আগস্ট রাতে আমার হাত কেটে ফেলতে হয়। চিকিৎসকরা বলেন, হাত বাঁচাতে হলে নিজে বাঁচবো না, একটা সময় হাতে ইনফেকশন হয়ে যাবে। আমার পিতা আলাল উদ্দিনের ফার্নিচারের দোকান আছে। পরিবারের সবাই আজমপুরে থাকে। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ। ছয় ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। তিনি বলেন, ছাত্ররা আমার ভাই, ভাইদের জন্য আন্দোলনে নেমেছিলাম। দেশের জন্য আমার শরীরের অঙ্গ দিয়েছি, এটা নিয়ে আমি গর্বিত। তবে শরীরের প্রতিটি অঙ্গই গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে তো দুশ্চিন্তা হয় মাঝে মাঝে। জীবনে অনেক স্বপ্ন ছিল, কিন্তু এখন কোনো স্বপ্ন দেখছি না। জীবনটা এখন আর আগের মতো নেই, নতুন করে স্বপ্ন সাজাতে হবে। আগে স্বপ্ন ছিল বিদেশ যাওয়ার সেটি তো আর হলো না।

শুধু আতিকুল নয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন অনেকে। গুলির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হওয়ায় কাটতে হয়েছে অনেকের হাত-পা। কারও পায়ে আবার লাগানো হয়েছে রড। পঙ্গু হাসপাতালের তথ্য মতে, ছাত্র আন্দোলনে আহত ১১২ জন ভর্তি রয়েছেন। এরমধ্যে ৫২ জন শিক্ষার্থী। আহত ২১ জনের হাত-পা কাটা হয়েছে। এরমধ্যে ১৭ জনের পা কেটে ফেলা হয়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। হাসপাতালটিতে এ পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন ৭০০ জন। গতকাল সরজমিন দেখা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্র ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অনেকে পঙ্গু হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তায়। কারও রড লাগানো, কারও হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ। চিকিৎসক-নার্সরা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। স্বজনদেরও রয়েছে সারিয়ে তোলার প্রচেষ্টা।

১৯ বছর বয়সী রাকিবের হাঁটুর উপরে গুলি লাগে। তিনি হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি-১ এর জি-২৪ নম্বর বেডে ভর্তি। রাকিবের বাম পায়ের হাঁটুর উপর পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়েছে। মা রিনা বেগম বলেন, ২০শে জুলাই আন্দোলনে গিয়ে রাকিবের পায়ে গুলি লাগে। আমার ছেলে সেলুনে কাজ করতো। ২১ তারিখে হাসপাতালে নিয়ে আসি। অবস্থা খারাপ হওয়ায় ২২ তারিখে রাকিবের পা কাটতে হয়। আমরা চিটাগাং রোডে ভাড়া থাকি। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। ১৩ ব্যাগের মতো রক্ত লেগেছে রাকিবের। ওর বাবা মুদি ব্যবসা করতো তাতেও আগুন লাগে। রাকিবকে একটি সেলুনে দিয়েছিলাম কাজ শেখার জন্য। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। ভেবেছিলাম সেলুনে কাজ শেখা হলে বিদেশ পাঠিয়ে দিবো। কিন্তু সে স্বপ্ন তো স্বপ্নই থেকে গেল। দুই ছেলের মধ্যে রাকিব বড়। তিনি বলেন, আমার ছেলেটা অনেক কান্নাকাটি করে পা হারিয়ে। গুলি লাগার পর ওর ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারিনি ভয়ে। চিকিৎসক বলেছেন, যদি ছয় ঘণ্টার মধ্যে ভালো চিকিৎসা হতো তাহলে পা রক্ষা পেত। ঘটনার পর মদনপুর হাসপাতালে নিয়ে যায় ওর সঙ্গীরা। এরপর ঢাকা মেডিকেলে। সেখান থেকে হৃদরোগে পাঠানো হয়। আমার ছেলের পা কি আর ফিরে পাবো। 

মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আহমাদ। পুলিশ-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় রাস্তায় পড়ে যায়। এ সময় পুলিশের গাড়ি তার পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। আব্দুল্লাহ জি-৩৬ নম্বর বেডে ভর্তি। তিনি বলেন, জীবনে অনেক স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার। বাবা-মায়েরও সম্মতি ছিল। এখন সিএসইতে পড়ার চিন্তা করছি। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়াশোনা করি। ৪ঠা আগস্ট সাড়ে ১২টার দিকে মিরপুর-১০ নম্বরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হলে দৌড়াতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে যাই। এ সময় পুলিশের একটি গাড়ি আমার পায়ের উপর থেকে চলে যায়। আমার ডান পায়ের হাড় ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। রক্তনালী ছিঁড়ে যায়। ডান হাতের কনুই ও মাথায় আঘাত লাগে। এখন সুস্থ হতে এক বছরের বেশি সময় লাগবে। আগমী বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবো। কিন্তু পায়ের যে অবস্থা তাতে আমার কি হবে? আগের মতো আর স্বাভাবিক হতে পারবো না। আমাদের বাড়ি মাদারীপুরে। মিরপুর-১৪ নম্বরে ভাড়া থাকি। বাবার কাপড়ের দোকান রয়েছে। আব্দুল্লাহর মা বিলকিস বলেন, আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় আছি। আমাদের ইচ্ছা ছিল আর্মিতে দেয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন তো আমার পায়ের সঙ্গে ভেঙে গেছে। পড়াশোনা এখন যদি বন্ধ করি তাহলে আমার ছেলের ভবিষ্যৎ আরও খারাপ হবে। 

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) উপ-পরিচালক ডা. মো. বদিউজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে যারা চিকিৎসাধীন আছেন তাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ ও অন্যান্য ইনজুরি। এখানে যত রোগী এসেছেন তারা সবাই গুরুতর ছিলেন। আহতদের সুস্থতার একটা লেভেলে যাওয়ার পর তাদেরকে ছাড়পত্র দিচ্ছি। হাড় ভাঙার ক্ষেত্রে সুস্থ হতে অনেক সময়ের ব্যাপার। শুধু হাড় ভাঙেনি অনেকের মাংস ইনজুরিও হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অনেকের হাত-পা কেটে ফেলতে হয়েছে। রোগীদের সব সেবা আমরা বিনামূল্যে দিচ্ছি। রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা কোনো ভাবেই অবহেলা করছি না। আমরা চেষ্টা করছি আহতদের চিকিৎসা সর্বোচ্চটা দিতে।    

পাঠকের মতামত

হাসিনা কে কিয়ামত পরযন্ত ফাসিতে ঝুলিয়ে রাখলেও বিচার সঠিক হবে না। আরো কঠিন বিচার করতে হবে।

জনগণ
২৯ আগস্ট ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৩ পূর্বাহ্ন

খুনি হাসিনা ও তার সহযোগীদের ফাঁসি দিতে হবে। এক নং খুনি হাসিনা। তাকে অবশ্যই ফাঁসিতে ঝুলাতে হবে। এতগুলো মানুষের প্রাণ বৃথা যেতে পারে না।

Mohammed Rafiqul Isl
২৮ আগস্ট ২০২৪, বুধবার, ২:১৯ অপরাহ্ন

সরকারের কাছে অনুরোধ করছি আহত, নিহত সবাইকে যেন পরিপূর্ণ ভাবে পুনর্বাসন করা হয়।

Mohd Saleh babul
২৮ আগস্ট ২০২৪, বুধবার, ৮:৪৩ পূর্বাহ্ন

আমি আহত ছাত্রদের চিকিৎসার জন্য বিদেশ থেকে কিছু টাকা পাঠাইতে চাই। কিন্ত সরকারি কোন ব্যাংক একাউন্ট প্রচার না করায় পারছি না । আমার মনে হয় একটি ছোট্ট এপস তৈরী করে প্রচার করা উচিত। অনেক প্রবাসী সাহায্য করবে আমার বিশ্বাস।

Kazi
২৮ আগস্ট ২০২৪, বুধবার, ৬:৩৯ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status