বাংলারজমিন
কোটা সংস্কারের দাবিতে উত্তাল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা
বাংলারজমিন ডেস্ক
১৬ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার
বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল করেছে দেশের বিভিন্ন জেলার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় আহত হয়েছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। বিস্তারিত আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে-
চবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা
চবি প্রতিনিধি: সকল গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে চট্টগ্রাম শহর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় ১জন পুলিশসহ অন্তত ১০জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। গতকাল বিক্ষোভের জন্য ক্যাম্পাস থেকে দুপুর আড়াইটার শাটল ট্রেনে শহরের উদ্দেশ্যে হওনা হলে ট্রেনটি আটকে দেয় নেতাকর্মীরা। পরে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ও কাটাপাহাড় সড়কে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ক্যাম্পাসে দুইজন গুরুতর আহত হয়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর রেল স্টেশনে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা করা হয়। রেললাইনের পাথর নিক্ষেপ করা হয় শিক্ষার্থীদের ওপর। এতে ১জন পুলিশসহ ৭ জন আহত হয় বলে জানা গেছে।
ক্যাস্পাস থেকে শহরগামী শাটল ট্রেন থেকে কোটা আন্দোলনে চবির সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফিকে তুলে প্রক্টরের কাছে নিয়ে যান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় রাফির ছাত্রত্ব বাতিলের জন্য প্রক্টরের সঙ্গে উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় ছাত্রলীগের অনুসারীদের। প্রক্টরিয়াল বডির সামনে তার ওপর চড়াও হয়।
ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দাবি, তালাত মাহমুদ রাফি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এরপরও যেহেতু সে কোটা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে, তাই তার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অধিকার নেই।
ইবিতে শিক্ষার্থীকে মারধর ছাত্রলীগ নেতার
ইবি প্রতিনিধি: কোটা সংস্কার দাবি ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলে যাওয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করেছে শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান হাফিজ। ভুক্তভোগী মাহফুজ উল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। গতকাল সকালে হল কক্ষে গিয়ে ওই শিক্ষার্থীকে মারধর করা এবং হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়া হয় বলে জানায় ভুক্তভোগী। এই ঘটনার বিচার চেয়ে প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট হল প্রভোস্টের কাছে লিখিত আবেদন দিয়েছেন তিনি।
ভুক্তভোগী মাহফুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়াউর রহমান হলের ৪২০ নং কক্ষে থাকেন। তিনি জানান, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সোহানুর রহমান রুমের সামনে এসে ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য আমাকে ডাকাডাকি করে। কিছুক্ষণ পর হাফিজ কক্ষের সামনে আসে এবং রোববার রাতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ মিছিলে গিয়েছিলাম কি-না জানতে চান। আমি গিয়েছি জানার পর তিনি বলেন, ‘তুই কি রাজাকার? রাজাকার না হলে ওই মিছিলে গেলি কেন?’ তখন আমি তাকে জানাই, ‘আমি রাজাকার হবো কীসের জন্যে? কোনটা ব্যঙ্গাত্মক আর কোনটা আসল সেটা তো আপনার বোঝা উচিত।’ এরপর তার সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। এরই একপর্যায়ে তিনি কক্ষে থাকা ঝাড়ু দিয়ে মাথায় সজোরে আঘাত করেন। আরও মারতে উদ্যত হলে আমাকে ডাকতে আসা সোহান এবং সৌরভ তাকে ঠেকান। তবে যাওয়ার সময় তিনি বলে যান, ‘ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম থেকে ফিরে যেন তোকে হলে না দেখি। যদি কেউ কিছু বলে, বলবি আমার নাম হাফিজ। তোর কে আছে দেখবোনে।’
এদিকে মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতার শাস্তির দাবিতে গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে প্রশাসন ভবনের সামনে মানববন্ধন করেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ভুক্তভোগী মাহফুজ বলেন, আমি এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমাকে যথাযথ নিরাপত্তা প্রদান এবং মারধর ও হুমকি প্রদানের ঘটনায় যথাযথ বিচারের দাবি জানাচ্ছি।
যশোরে শিক্ষার্থীদের মিছিলে ছাত্রলীগের হামলা
স্টাফ রিপোর্টার, যশোর থেকে: কোটা বিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে যশোরে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকালে ও দুপুরে যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে তারা বিক্ষোভ করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, সরকারি এমএম কলেজ থেকে আসা একটি মিছিলে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এমনকি মাসুম নামে এক কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এক ছাত্রকে ধরে নিয়ে গেছে তারা।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুপুরে পালবাড়ি থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। মিছিলটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় ও সরকারি এমএম কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যুক্ত হন। দুপুর একটার দিকে শহরের মুজিব সড়কের প্রেস ক্লাব যশোরের সামনে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন সরকারি এমএম কলেজ থেকে আসা একটি মিছিলে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এমনকি মাসুম নামে এক সংগঠককে ধরে নিয়ে গেছে তারা।
জাবি শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা
জাবি প্রতিনিধি: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ২ জন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীসহ ৩ জন আহত হয়েছেন। গত রোববার (১৪ই জুলাই) দিবাগত রাত ৩টার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এর আগে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাত ১০টার দিকে বিভিন্ন আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ স্লোগান দিতে থাকেন।
এরপর রাত সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকায় জড়ো হন বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা। তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে ২ জন আন্দোলনকারীকে অবরুদ্ধ করে ফোন তল্লাশির অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এই খবর জানাজানি হলে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বটতলা এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে হলের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় দুই শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে মোবাইল তল্লাশির ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে প্রাধ্যক্ষকে হলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখানোর অনুরোধ জানান আন্দোলনকারীরা।
এরপর রাত দেড়টার দিকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। মিছিলটি রাত সোয়া ২টার দিকে ফের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে গেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাধা দেন এবং মুখোমুখি অবস্থান নেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর কবিরসহ কয়েকজন শিক্ষক দুই পক্ষকে থামানোর চেষ্টা করেন। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের জামায়াত-শিবির আখ্যা দেন ও নারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে গালাগাল করেন।
একপর্যায়ে রাত পৌনে ৩টার দিকে বাধা উপেক্ষা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পাল্টা ধাওয়া দেন শিক্ষার্থীরা। পরে আন্দোলনকারীরা হলের ফটকে গেলে তাদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। হামলার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী ৪৬তম ব্যাচের ছাত্র প্রাচুর্যসহ বেশ কয়েকজন হামলা করছেন।
এদিকে ছাত্রলীগের হামলায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আহসান লাবিব এবং নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিহা আহত হয়েছেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তাও আহত হয়েছেন। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা দেয়া হয়।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ নাজমুল হাসান তালুকদার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উস্কে দিয়েছেন। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। পরে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে হলের প্রাধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার বলেন, ‘আজ যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এভাবে হল চালানো সম্ভব না। আমি প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করছি।’
অন্যদিকে গতকাল বেলা ১১টায় ভিসি অধ্যাপক নূরুল আলম বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। সেখানে তদন্ত কমিটি গঠন করার মাধ্যমে ১০/১৫ দিনের মধ্যে হামলাকারীদের চিহ্নিত করে বিচার করা হবে বলে জানান ভিসি।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলা, আহত ৫
বেরোবি প্রতিনিধি: কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত রোববার দিবাগত রাতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সহস্রাধিক শিক্ষার্থী মিছিল বের করেন। মিছিল শেষে ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীরা মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এ সময় দুপক্ষের উত্তেজনার মধ্যেই ঢিল ছোড়াছুড়িতে অন্তত ৫ জনের মতো আহত হন।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, রোববার (১৪ই জুলাই) দিবাগত রাত ২টায় মহাসড়কে মিছিল শেষে আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছিলাম। মেয়েদের হলে পৌঁছে দিয়ে যার যার মতো মেস বা হলে যাচ্ছিলাম। এ সময় আগে থেকেই দেশীয় অস্ত্র ও ইট-পাটকেল নিয়ে প্রস্তুত থাকা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ছাত্রলীগকে ধাওয়া করে। ছাত্রলীগ তখন ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। আমাদের অনেকেরই গায়ে আঘাত লেগেছে। এ সময় তাদের প্রতিহত করতেই আমরাও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করি। কয়েকজন আহত হওয়ায় তাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।