দেশ বিদেশ
অপরাধে জড়াচ্ছেন হাসপাতালের আনসার সদস্যরা
সুদীপ অধিকারী
১৬ জুন ২০২৪, রবিবারসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রোগীদের ভোগান্তি কমাতে ও সার্বিক নিরাপত্তায় মোতায়েন করা হয়েছে আনসার সদস্যদের। তবে হাসপাতালে আসা রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, দুর্ব্যবহার, রোগী ও স্বজনদের গায়ে হাত তোলাসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন আনসার বাহিনীর কিছু সদস্য। রোগীর স্বজনকে সংঘবদ্ধ হয়ে মারধোর, শিশুকে মায়ের কোল থেকে নিয়ে ছুড়ে ফেলা, টাকা কেড়ে নেয়া, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়ারও অভিযোগে থানা পুলিশ কর্তৃক আনসার সদস্যদের আটকের ঘটনাও ঘটেছে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিটিউট, জাতীয় শিশু হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালসহ রাজধানীর বেশকিছু হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, এসব হাসপাতালের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। অস্থায়ীভিত্তিতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছেন তারা।
বুধবার সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, মেডিসিন-১, মেডিসিন-২, ক্যানসার ভবন, কেবিন ব্লকসহ সব জায়গাতেই আনসার সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। হাসপাতালের অভ্যন্তরের রাস্তায় রোগীদের চলাচলের সুবিধার্থে রিকশা, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন তারা। হাসপাতালে আগত রোগীদের বিভিন্ন কাউন্টারের ঠিকানা, ডাক্তারের চেম্বার, ডায়গোনেস্টিক টেস্টের ঠিকানা দেখিয়ে দেয়াসহ বিভিন্নভাবে মানুষকে সাহায্য করছেন আনসার সদস্যরা। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে কিছু অসাধু সদস্য আগে ডাক্তারের সিরিয়াল পাইয়ে দেয়া, আগে রিপোর্ট নিয়ে দেয়া, টেস্টের টাকা আগে জমা দিয়ে দেয়া, সহজে টেস্ট করে দেয়াসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে হাসপাতালটিতে আসা মানুষদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। প্রতিদিন সকালে পিজির বহির্বিভাগের মেডিসিন-১, মেডিসিন-২ ও ক্যান্সার ভবন এলাকায় এসব অসাধু চক্রের সদস্যদের বিচরণ সবচেয়ে বেশি। তারা সুযোগ বুঝে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের নিজেদের আত্মীয় পরিচয় দেন। এরপর ঢুকিয়ে দেন ডাক্তারের চেম্বারে। কেউ আবার বাইরে থেকেই টাকার লেনদেন সেরে রোগীর টিকিট ভাজ করে পকেটে নিয়ে এসে টাকা জমা দেয়ার কাউন্টারে সবার আগে ঢুকিয়ে দেন। শত শত মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও টাকার বিনিময়ে সবার আগে রিপোর্ট নিয়ে নেন এই আইন রক্ষাকারী সংগঠনের বেপরোয়া কিছু সদস্য। গতকাল সকালে রাজধানীর ধোলাইপাড় থেকে পিজির বহির্বিভাগের বক্ষব্যাধি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রাবেয়া আক্তার নামে এক ষাটোর্ধ্ব মহিলা বলেন, আমরা সেই সকাল থেকে এসে বসে আছি। কতো মানুষ লাইনে। এখানো ডাক্তার দেখাতে পারেনি। আর এই আনসাররা এসেই তার লোককে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কেউ আবার নিজেকে হাসপাতালের স্টাফ পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে থাকা মানুষগুলোকে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু আমরা বসেই আছি। সব জায়গাতেই এই একই অবস্থা। নিচে টিকিট কাটতে গেলাম সেখানেও একই। শুধু বক্ষব্যাধি না হৃদরোগ, কিডনি, চর্ম, সার্জারি, সব কয়েকটি ইউনিটেই একই অবস্থা। এদিকে মেডিসিন-১ ভবনের নিচতলায় প্যাথোলজি টেস্ট ও টেস্টের টাকা জমা দেয়া হয়। সেখানেও থাকে দীর্ঘ লাইন। সেখানে টেস্টের টাকা জমা দিতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ইকবাল আহমেদ নামে এক রোগী স্বজন বলেন, আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি আর পাশ দিয়ে আনসার সদস্যরা পকেটে করে কাগজ নিয়ে এসে সবার আগে টাকা জমা দিয়ে চলে যায়। কিছু বলতে গেলে উল্টো গরম দেয়। তাদের অন্য সদস্যদেরকে ডেকে এনে শাসায়। এরা সকলে সংঘবদ্ধ হয়ে এই কাজগুলো করে। এদিকে পিজির ক্যান্সার ভবনের এক্সেরে করাতে গিয়েছিলেন মিঠু বিশ্বাস। সেখানে দীর্ঘ লাইন থাকায় তাকে আরেক দিন আসতে বলা হয়। তখন তাকে এক আনসার সদস্য বলেন, ‘টাকা দিলে শুধু দিনের দিনেই না, অনেকের আগেই এক্স-রে করে দেয়া যাবে। ওই আনসার সদস্যকে খুশি করেই নিজের কাজ সেরে বাসায় যান মিঠু।
এদিকে জাতীয় হৃদরোগ ইনিস্টিটিউটে দায়িত্বরত কিছু আনসার সদস্যের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ রয়েছে। রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার যেন নিত্যদিনের ঘটনা। শাহরিয়ার হোসেন নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, হৃদরোগের আনসার সদস্যরা যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে। বিশেষ করে সকালে হাসপাতালে ঢোকার সময় হঠাৎ হঠাৎ ভিজিটরের কার্ড দেখাতে বলে, আবার বলে একজনের বেশি যাওয়া যাবে না। কিন্তু বিশ টাকা হাতে গুজে দিলেই সব মাফ। তিনি বলেন, আমার বাবাকে নিয়ে আমি এই হাসপাতালে গত তিনদিন অবস্থান করছি। প্রথমে সিসিইউতে রাখা হয়। সেখানে আমি ছাড়া আর কেউ তার সঙ্গে ছিল না। প্রথমদিন আমি বাবাকে রেখে নিচে ওষুধ নিয়ে ফিরে আসলে আমাকে ঢুকতে নিষেধ করে। আমি বলি আমার বাবাকে ওষুধ দিতে হবে, সেখানে কেউ নেই, ডাক্তার আমাকে ওষুধ আনতে বলেছিল। তখন দায়িত্বরত আনসার সদস্য আমাকে তো ঢুকতে দেয়ইনি উল্টো যা তা বলে গালি দিয়েছে। মো. মিরাজ নামে এক স্বজন বলেন, আমারা বাবার পায়ে ব্লক ধরা পড়েছে। গতকাল রাতে মুন্সীগঞ্জ থেকে এখানে এসেছি। আসার পর ইমার্জেন্সি থেকে বলা হয় রাতে ভর্তি করার সুযোগ নেই, সকালে টিকিট কেটে ডাক্তার দেখাতে হবে। ডাক্তার যদি ভর্তি লিখে দেয় তাহলেই ভর্তি করা হবে। কিন্তু আমাদের ঢাকায় তেমন থাকার জায়গা নেই। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় বিছানা করে রেখেছিলাম। রাতে সেখানে গিয়ে আনসার সদস্যরা হঠাৎ আমাদের বকাঝকা শুরু করেন। বলেন, রাস্তায় গিয়ে থাকতে। অনেক অনুরোধ করেছিলাম, তারপরও আমার অসুস্থ বাবাকে নিয়ে সারারাত হাসপাতালের বাইরে থাকতে হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে কিছুদিন আগেই ঘুষের টাকা না দেয়ায় মায়ের কোল থেকে অসুস্থ শিশুকে কেড়ে নিয়ে ছুড়ে মাটিতে ফেলে দেয়ার অভিযোগে দুই আনসার সদস্যকে আটক করে শেরেবাংলা থানা পুলিশ। রোগীর স্বজনকে মারধোর করাসহ মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়ারও অভিযোগ উঠে তাদের বিরুদ্ধে। সরজমিন গেলে হাসপাতালে আগত শিশু রোগীর অভিভাবকেরা জানান, পান থেকে চুন খসলেই আনসাররা খারাপ ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে নিজেদেরকে অনেক ছোট মনে হয়। রায়হান নামে এক স্বজন বলেন, জরুরি বিভাগে রোগী দেখাতে গেলেই আনসার সদস্যরা টাকা চায়। টাকা দিতে অস্বীকার করলে খারাপ ব্যবহার করে। বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেয়। কিন্তু টাকা দিলে কোনো সমস্যাই থাকে না।
শিশু হাসপাতালের অদূরেই অবস্থিত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল বা পঙ্গু হাসপাতাল। সেখানেও এম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে। খালি চোখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলের আনসার সদস্যরা আবার অনেক কঠোর। কিন্তু মোবাইলের এমবি কার্ড, ফ্লেক্সি বা চা খাওয়ার টাকা দিয়ে সহজেই তাদের দিয়ে অসাধ্য সাধন করা যায়। এ বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. ইয়াছির রহমান বলেছেন, মূলত আনসাররা হাসপাতালের কোনো সদস্য না। আনসারের হেড অফিসের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে তাদের দিয়ে আমাদের হাসপাতালের নিরাপত্তার দিকটা দেখা হয়। তাদের হেড অফিসই তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করেন। কোনো সমস্যা হলে আমরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাই। তারাই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, আমরা সবসময় আমাদের নিরাপত্তার বিষয়ে খেয়াল রাখি। এরপরও যদি কারোর নামে অভিযোগ পাওয়া যায় আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর পরিচালক জাহানারা আক্তারের (প্রশাসন) অফিসিয়াল ফোন ও মোবাইলে (০১৭৩০০৩৮০০৬) একাধিক দিন একাধিকবার কল করেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তার নিরাপত্তায় থাকা সদস্য ও একাধিক সূত্র নিশ্চিত হওয়া গেছে তিনি অফিসেই আছে। তারপরও তিনি মানবজমিনের যোগাযোগে সাড়া দেননি।