শেষের পাতা
বাজেটের ৩ চ্যালেঞ্জ
এম এম মাসুদ
৩০ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবারএবারের বাজেট অধিবেশন শুরু হচ্ছে আগামী ৫ই জুন। পরের দিন ৬ই জুন ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এটি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশন। প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপনের সব প্রস্তুতি শেষ বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে আসন্ন বাজেটে বড় ৩ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হলো- মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়। এসব চ্যালেঞ্জের উত্তরণ ঘটিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যাবে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী।
জানা গেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ব্যয় বরাদ্দ রেখে বাজেট পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
সংসদ সচিবালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের (১) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ অধিবেশন আহ্বান করেছেন। এটি হবে বর্তমানে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট। আসন্ন বাজেট সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
মূল্যস্ফীতি: টানা ২২ মাস দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। খাদ্যপণ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য-উভয় খাতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার অব্যাহত আছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেও তা বজায় রয়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার ৯.৪১ থেকে ৯.৯৪ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। গত এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.২২ শতাংশ, যা মার্চে ছিল ৯.৮৭ শতাংশ।
রিজার্ভ: বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। বর্তমানে মোট রিজার্ভ কমে ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলারে (২৩.৭৭ বিলিয়ন) দাঁড়িয়েছে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এখন ১ হাজার ৮৩২ কোটি ডলার (১৮.৩২ বিলিয়ন)। প্রকৃত বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা কম। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে আজ এ তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজস্ব আদায়: গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫.৬১ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পরও, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বরং ঘাটতি ছাড়িয়ে গেছে ২৪ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম (জুলাই-এপ্রিল) ১০ মাসে বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ২৯.৪২ শতাংশ অর্জন করা যায়নি। আলোচ্য সময়ে আদায় হয়েছে ২ লাখ ৮৯ লাখ ৩৭৬ কোটি টাকার রাজস্ব। একই সময়ে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ১৩ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা।
এনবিআর প্রতিবেদন বলছে, চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হয়েছিল এনবিআরকে। পরে বড় অঙ্কের ঘাটতি পড়ে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে তা ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এনবিআর’র এক কর্মকর্তা বলেন, রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯২.২৮ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ছিল ৮৭.৮০ শতাংশ।
সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করার লক্ষ্য ঠিক করে দেয়া হতে পারে এনবিআর’কে। আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে রাজস্ব আদায় বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার কথা উল্লেখ করা হবে। এর মধ্যে ১০ লাখ বা এর বেশি মূসক (ভ্যাট) পরিশোধের ক্ষেত্রে ই- পেমেন্ট বা এ-চালান বাধ্যতামূলক করা হবে। বর্তমান ই-পেমেন্ট বা এ-চালান শুধু ৫০ লাখ টাকা বা তার বেশি ভ্যাট পরিশোধে ব্যবহারের বিধান আছে। এছাড়া ইলেকট্রনিকস ট্যাক্স ডিটেকশন সোর্স (ইটিডিএস) অনলাইন প্ল্যাটফরম চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি, সেবার মান উন্নয়ন ও রাজস্ব আদায় বাড়াতে আয়কর আইন, ২০২৩ প্রয়োগ করা হবে। এবারের বাজেটে আয়কর খাতে কর অবকাশ সুবিধা কাটছাঁট করা হতে পারে। বিত্তবানদের কাছ থেকে আয়কর আদায় বাড়াতে ব্যক্তিশ্রেণির সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হতে পারে।
সম্প্রতি গণভবনে অনুষ্ঠিত ২০২৪-২৫ সালের বাজেট প্রস্তুতির সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন-বিষয়ক বৈঠকে চলতি অর্থবছরের মতো আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটকেও ব্যয় সংকোচনমুখী করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী বাজেটেও বিলাসপণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে আগামী বাজেটের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য অর্থনীতিকে অনট্র্যাকে ফিরিয়ে আনা। একই সঙ্গে নিত্যপণ্য যাতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে, এগুলো নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে সরকার যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল, সেটির একটা রিফ্লেকশন দেখতে চাই। এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, মূল চ্যালেঞ্জ থাকবে মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়। আমরা সংকোচনমূলক সময় পার করছি। সংকোচন থেকে কীভাবে সমপ্রসারণ করা যায়, সেটিই চেষ্টা করছি।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেছিলেন, সামগ্রিকভাবে বলা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানিপণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রান্তিক মানুষের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবারের বাজেটের অগ্রাধিকারে থাকবে। নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে জানিয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, এবার বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। পাশাপাশি নিম্ন্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া যেসব খাত দীর্ঘদিন কর অবকাশ সুবিধা পেয়ে আসছে, সেসব খাত থেকে কর অব্যাহতির সুবিধা উঠিয়ে দেয়ার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী।
বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ঋণ: বাজেটের ব্যয় মেটাতে সরকারের ঋণনির্ভরতা আরও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের মতো আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের জন্যও সরকার বিপুল পরিমাণ ঋণ করতে যাচ্ছে। আগামী বাজেট হতে পারে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার। এর এক-তৃতীয়াংশ অর্থই আসবে দেশি-বিদেশি ঋণ হিসেবে। ঋণের পরিমাণ হতে পারে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। আগামী অর্থবছরে মোট ঋণের মধ্যে নিট বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো। বাকি ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে দেশি ঋণ। দেশি ঋণের মধ্যে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা নেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। বাকি ২০ হাজার কোটি টাকা নেয়া হবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য উৎস থেকে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে মোট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য বাস্তবভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া করজাল সমপ্রসারণেও বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
সুদ পরিশোধে বরাদ্দ বাড়ছে: সুদ পরিশোধের জন্য আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বড় আকারের অর্থ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। রাজস্ব আদায় প্রত্যাশা মতো না হওয়ার পাশাপাশি উন্নয়ন ব্যয় মেটানো-এসব ধরে নিয়েই সরকার বড় আকারের ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে। এই ঋণের বিপরীতেই গুনতে হবে বড় অঙ্কের সুদ। বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ থাকবে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে দেশি ঋণের সুদ ১ লাখ ৮ হাজার কোটি এবং বিদেশি ঋণের সুদ ২০ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ বছর আগের তুলনায় এ বরাদ্দ দ্বিগুণের কাছাকাছি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সুদ খরচ বাবদ ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো বলছে, অর্থবছর শেষে সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় আরও বাড়তে পারে।