প্রথম পাতা
আয়ু খাচ্ছে ঢাকার দূষিত বাতাস
নাজমুল হুদা
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রবিবারনার্সারি শ্রেণির শিক্ষার্থী তাহিয়া। পরনে স্কুল ড্রেস। কাঁধে ব্যাগ। হালকা বাতাসে রাস্তায় তখন তীব্র ধুলাবালি উড়ছিল। স্কুল ছুটির পর তাহিয়া এক হাতে মাকে ধরে, অন্য হাতে নাক চেপে রাস্তা পার হচ্ছিলো। তাহিয়ার মতো রাজারবাগ আইডিয়াল স্কুলের অনেক শিক্ষার্থীই তখন রাস্তা পার হচ্ছিল। তাহিয়ার মা তানিয়া আক্তার বলেন, বৃষ্টি না হলে রাস্তায় প্রচুর ধুলাবালি উড়ে। মাঝেমধ্যে হাঁচি হয়। ধুলাবালিতে এলার্জির কারণে সর্দিও লেগে যায়।
ঢাকায় ধুলাবালির এই অস্বাস্থ্যকর চিত্র সর্বত্র। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের সূচকে প্রায় বায়ুদূষণে শীর্ষ স্থান দখল করে নেয় ঢাকা। ২০১৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত টানা ৫ বছর সবচেয়ে খারাপ আবহাওয়ার নিরিখে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ নম্বরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বাংলাদেশে বায়ুদূষণ কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি। এই মাত্রা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সকালে মাঝেমধ্যেই ঢাকার বায়ুর মান ‘বিপজ্জনক’ অবস্থায় থাকে। আইকিউএয়ারের বাতাসের মানসূচকে গত এক মাসের ১৮ দিনই ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ ছিল ঢাকা। বাকি ১১ দিন ‘অস্বাস্থ্যকর’ ও একদিন ‘বিপজ্জনক’ ছিল ঢাকার বায়ু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে প্রতিটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত থাকলে বায়ুমান অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-এর বেশি হলে তা বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হয়। গত এক মাসের হিসাবে ঢাকার বায়ুমান ১৫১ থেকে ৪০০ স্কোরে ওঠানামা করেছে। স্কোর শূন্য থেকে ৫০-এর মধ্যে থাকলে বায়ুর মান ভালো, ৫১ থেকে ১০০ হলে মাঝারি বা সহনীয় এবং সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। তবে এই এক মাসে একদিনও ঢাকার বায়ুমান ১৫০ স্কোরের নিচে নামেনি। অর্থাৎ কখনো বিপজ্জনক, খুবই অস্বাস্থ্যকর কিংবা অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় রয়েছে ঢাকার বাতাস।
শুষ্ক মৌসুমে নির্মাণ কাজগুলো বেশি হওয়ার কারণে বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে উল্লেখ করে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, নিয়মিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে, সংস্কার কাজ হচ্ছে। কিন্তু নির্মাণ বিধি না মেনে এসব কাজ করায় দূষণ বাড়ছে। এ ছাড়া ইটের ভাটা এখন সর্বোচ্চ উৎপাদনের ভেতরে আছে। বড় বড় প্রকল্পের নির্মাণকাজ হচ্ছে। ঈদকে সামনে রেখে ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো রাস্তায় নামছে। ফলে প্রচুর বায়ুদূষণ হচ্ছে। তিনি বলেন, বায়ুদূষণের কারণে মানুষ সরাসরি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ফুসফুসের বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। গাছের উপর ধুলাবালি পড়ায় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। ফুল, ফলের উপর ধুলাবালি পড়ছে। এতে কীটপতঙ্গ পরাগায়ন করতে আসে না। দীর্ঘমেয়াদি বায়ুদূষণ চলতে থাকলে অনেক বেশি কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমতে থাকবে।
গত ৩০ দিনের আইকিউএয়ারের বাতাসের মানসূচকে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসের ২৪, ২৬, ২৭, ২৯, ৩০ ও ৩১ তারিখ ও ফেব্রুয়ারি মাসের ১, ৪, ৫, ৬, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৮ তারিখে ঢাকার বায়ুমানের স্কোর ছিল ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে। অর্থাৎ এই ১৮ দিন ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ ছিল ঢাকার বাতাস। আর জানুয়ারি মাসের ২৮ তারিখ ও ফেব্রুয়ারি মাসের ২, ৩, ৭, ৮, ৯, ১৭, ১৯, ২০, ২১ ও ২২ তারিখে ঢাকার বায়ুমানের স্কোর ছিল ১৫১ থেকে ২০০-এর মধ্যে। অর্থাৎ এই ১১ দিন ঢাকার বাতাস ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’। আর এসব ছাপিয়ে গত ২৫শে জানুয়ারি ঢাকার বায়ুমানের স্কোর ছিল ৩১৭ যা ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে বিবেচিত করা হয়। মানসূচকে অবশ্য রিয়াল টাইমে প্রায়ই ঢাকার বায়ুরমান ‘বিপজ্জনক’ অবস্থায় ওঠে। বিভিন্ন শহরকে ছাপিয়ে বায়ুদূষণে প্রায়ই শীর্ষে উঠে ঢাকা।
আইকিউএয়ার ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, ঢাকা চারদিক থেকেই দূষণের সম্মুখীন। একটি উচ্চ জনবহুল শহর হওয়ায় এখানে ব্যাপক গাড়ি, মোটরবাইক এবং ট্রাক চলাচল করে এবং যার কারণে তীব্র বায়ুদূষণ দেখা যায়। এসব যানবাহনের বেশির ভাগেরই বয়স, ফিটনেস, ইঞ্জিনের গুণমান বা ব্যবহৃত জ্বালানি নিয়ে কোনো কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যদিয়ে যেতে হয় না। এর ফলে এই যানবাহনগুলোর বড় একটি অংশই যখন রাস্তায় চলে তখন অন্য যানবাহনের তুলনায় অনেক বেশি দূষণ নির্গত করে। এগুলো প্রায়শই ডিজেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানিতে চলে এবং বায়ুতে উচ্চমাত্রার দূষিত পদার্থ ছেড়ে দেয়।
বায়ুদূষণের কারণে মানুষের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পাবলিক হেলথ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ড. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি মানবজমিনকে বলেন, বায়ুদূষণের প্রভাবে যাদের অ্যাজমা আছে তাদের তাৎক্ষণিক তা বেড়ে যাচ্ছে। আর অনেক মানুষের ফুসফুসে সমস্যা হচ্ছে। ইনফেকশন হচ্ছে। ফুসফুস থেকে ধুলিকণা রক্তের মধ্যে চলে যাওয়ায় ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। এতে স্ট্রোক, হার্টের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। আর যারা প্রেগনেন্ট নারী তারাও সমস্যায় পড়ছে। যাদের আগে থেকেই বিভিন্ন রোগ রয়েছে তাদের তা বেড়ে যাচ্ছে। এটা থেকে মুক্তি পেতে সামগ্রিক পরিকল্পনা দরকার। এই বিষয় নিয়ে মানুষের আওয়াজ তোলা উচিত। সবাইকে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরা উচিত।
সাবের হোসেন সাহেব ওসমানি উদ্দ্যানে গিয়ে ধুঁয়া দুষন বন্ধ করেছে। এভাবে সম্ভব নয়। টেবিলের কাজের মাধ্যমে কাজ করতে হবে।