প্রথম পাতা
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?
সুদীপ অধিকারী
১৬ মে ২০২৫, শুক্রবার
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একের পর এক ঘটছে অঘটন। হত্যা, ছিনতাই, মাদক সেবনসহ নানা অপকর্মের নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে ঐতিহাসিক এ স্থান। আর এই সব ঘটনার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনসহ ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়। ভুক্তভোগীদের দাবি-আলোচিত কোনো ঘটনা ঘটলেই কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। কিছুদিন পরে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় পরিস্থিতি। গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টায় রমনা কালীমন্দিরের উত্তর পাশে বটগাছসংলগ্ন পুরনো ফোয়ারার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এস এম শাহরিয়ার আলম সাম্যকে হত্যা করা হয়েছে। সাম্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তরের ছাত্র ছিলেন। তিনি স্যার এ এফ রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন। সাম্য হত্যাকাণ্ড নিয়ে ছাত্রদল বিক্ষোভ শুরু করলে টনক নড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে ঢাবি’র কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমানকে প্রধান করে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাত আটটার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়াও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট স্থায়ীভাবে বন্ধ করা, অবৈধ দোকান উচ্ছেদ, মাদক ব্যবসা বন্ধ ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান পরিচালনা, নিয়মিত মনিটরিং ও অভিযানের জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি কমিটি গঠন, উদ্যানে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ও ক্লোজড সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরা স্থাপন এবং সেগুলোর নিয়মিত মনিটরিং করা, উদ্যানে একটি ডেডিকেটেড পুলিশ বক্স স্থাপন এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও রমনা পার্কের মতো সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা চালুসহ ৭টি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি ঠিক কারা সাম্যকে কী কারণে হত্যা করেছে।
এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নারী-পুরুষসহ অন্তত ৩০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে। যাদের বেশির ভাগেরই পরিচয় পর্যন্ত শনাক্ত করতে না পেরে বেওয়ারিশভাবে দাফন করা হয়েছে। এদের মধ্যে গত ৪ঠা জানুয়ারি রাজধানীর শাহবাগ থানাধীন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে এক অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে ক্যান্টিনের পাশে ফাঁকা জায়গা থেকে অজ্ঞাতনামা ওই যুবককে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে ঢামেকে নেয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। গত বছরের ২৭শে জানুয়ারি সকাল ৯টার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পামগাছের নিচে থেকে ৫০/৬০ বছর বয়সী এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমেও তার পরিচয় শনাক্ত করতে না পেরে তাকেও আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে বেওয়ারিশভাবে দাফন করা হয়। ’২৩ সালের ২১শে এপ্রিলেও উদ্যান থেকে ২০/২২ বছরের এক নারীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই বছরেরই ৯ই ফেব্রুয়ারিতে একই স্থান থেকে হৃদয় খান (৩৯) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। তারও মৃত্যুর কারণ আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। এর আগে ’২১ সালের ১লা জুন আবুল হাসান ৩২ বছর বয়সী এক যুবককে উদ্যানের মধ্যে মারধর করার পর হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। সে ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার দা সূর্যসেন হলের তৎকালীন ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মারুফ হাসান সুজনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ। ’২২ সালের ১৮ই জুলাই বিকালে একইভাবে বিল্লাল হোসেন নামে ত্রিশ বছরের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ছাড়াও আরও অনেক হতাহতের ঘটনা আছে, যা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর করা হয়নি।
আর শুধু হত্যাকাণ্ডই নয় রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারের এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। নারী-পুরুষ এক সঙ্গে দেখলেই মারধর করে তাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেয়া হয়। তাই নিয়মিত ঢাবি ক্যাম্পাসে চলাচলকারীরা কেউই সন্ধ্যার পর উদ্যানের দিকে পা বাড়ান না। এমনই এক ভোক্তভোগী কবিতা দে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই নারী বলেন, আমার স্বামী একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। আমরা ছুটির দিনে সময় পেলে প্রতিনিয়তই রমনা কালীবাড়ি এলাকায় ঘুরতে আসি। কয়েকদিন আগে আমরা রমনা কালীবাড়ি থেকে ফেরার পথে হঠাৎ আমি আমার স্বামীকে বলি চলো উদ্যানের ভেতর থেকে একটা পাক দিয়ে আসি। আমরা মুক্তমঞ্চের পেছনদিক দিয়ে হেঁটে মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একদল লোক এসে আমার স্বামীকে জাপটে ধরে। আর আমার গলায় ছুরি ধরে। বলে- যা আছে দিয়ে যা, না হলে জানে মেরে ফেলবো। আমার স্বামী তখন তাদেরকে বলে আমার কাছে অফিসের ল্যাপটপ রয়েছে। এটা দেয়া যাবে না। এরপরই আমার স্বামী ও আমাকে বেধড়ক মারধর শুরু করে তারা। আমার স্বামীর হাত ভেঙে যায়। মাথা ফেটে যায়। এক পর্যায়ে জীবন বাঁচাতে আমরা তাদেরকে সবদিয়ে দিতে বাধ্য হই। পরে পেছন থেকে একদল লোক আমাদের চিৎকারের শব্দ শুনে তাদেরকে ধাওয়া দিলে তারা মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে যায়। এর আগে গত ২১শে জানুয়ারি এক নারী পুলিশ তার আত্মীয়র সঙ্গে দেখা করতে এসে ছিনতাইয়ের শিকার হন। তাকে মারধর করা হয়। ওই ঘটনায় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটকও করে পুলিশ। গত বছরের ১০ই সেপ্টেম্বর গভীর রাতে উদ্যানের ভেতর ৬৫ বছরের এক নারীকে নির্যাতন করা হয়।
মো. রুবেল হোসেন নামে উদ্যানে নিয়মিত চলাচলকারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারের এক বাসিন্দা বলেন, এই উদ্যানের ভেতর অনেক কিছু চলে। পুলিশ-প্রশাসন সব জানে। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। তিনি বলেন, এখন রাত ৮টার পর থেকে নাকি উদ্যান বন্ধ থাকবে। আগেও তো বন্ধ ছিল। কোনো লাভ তো হয়নি। উল্টো বাইরে থেকে গেট বন্ধ থাকায় ভেতরে মাদকের বেচাকেনা আরও ভালো হয়। তিনি বলেন, উদ্যানের ভেতরে যেই আনসার সদস্যরা আছেন তারাই এইসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। তাদেরকে বখরা দিয়ে রমনার গেট দিয়ে ঠিকই সকলে মাঠের মধ্যে ঢোকে। তিনি বলেন, উদ্যানের ভেতরে রাতে কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। যে কেউ, যেকোনো স্থানে দাঁড়িয়ে মাদক কিনছে ও সেবন করছে। আর এই মাদকের বিক্রেতারা উদ্যানের মধ্যে ফেরি করে মাদক বিক্রি করেন।
তানভীর নামে এলাকাটির আরেক বাসিন্দা বলেন, এই উদ্যানে শুধু মাদক সেবনই হয় না, চলে দেহ ব্যবসাও। মূলত উদ্যানের ভেতর কয়েকটি স্পট রয়েছে- মুক্তমঞ্চ, ফুড কিওস্ক ক্যান্টিন, স্মৃতিস্তম্ভ, ছবিরহাট, রমনার পুকুর পাড়, শিখা চিরন্তনের পেছনে, হাইকোর্টের গেট, মাঠ। এই প্রতিটি স্পটেই দিনে রাতে মাদকসেবীদের আড্ডা বসে। আর এই মাদকের যোগান আসে চার নেতার কবর ও হাইকোর্ট মাজার এলাকা থেকে। তিনি বলেন, এই ছিনতাই মাদকের নিয়ন্ত্রণ আগে ছিল ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে। তারা দিনপ্রতি মাসোহারা নিয়ে এই মাদকের ব্যবসা করাতেন। বিনিময়ে মিছিল মিটিংয়ে লোক জোগাড় করে দিতো এই মাদকের ব্যবসায়ীরা। শুধু মাদক নয় উদ্যানের ভেতরে ও বাইরের পাশ দিয়ে দোকান বসিয়েও টাকা উঠানো হয়। ৫ই আগস্টের পর ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস ছাড়ার পর এখন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠেনর নেতারা নিজেদের ক্ষমতাশালী দাবি করে এই মাদক, ছিনতাই ও হকারি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাই পুলিশ সদস্য দেখার পর মাদক বিক্রেতাদেরকে কিছুই বলে না। কারণ তাদের আটক করার পরই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তাদেরকে ছেড়ে দিতে চাপ প্রয়োগ করা হয়। ক্যাম্পাসের ভেতরের দোহাই দেয়ায় পুলিশও তেমন কিছুই করতে পারে না।
এসব বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মনসুর বলেন, প্রতিদিনই কোনো না কোনো আন্দোলন শাহবাগে থাকে। জন দূর্ভোগ এড়াতে সেগুলোকে আমাদের আগে প্রাধান্য দিতে হয়। এরপরও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অবস্থা ফেরাতে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। আগের চেয়ে অনেকটা কমে এসেছে। তবে পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। তাই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে যৌথ বাহিনীর অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করছি ধীরে ধীরে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
এদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যে অবৈধ দোকান বসানো নিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট নজরুল ইসলাম বলেন, এই উদ্যানের মধ্যে যেনো কোনো অবৈধ স্থাপনা না থাকে এই জন্য আমরা প্রায়ই উচ্ছেদ করি। কিন্তু আমরা যাওয়ার পর তারা আবারো বসে যায়। কারণ এদের পেছনে অনেক ছাত্রনেতা রয়েছে। যারা টাকা খেয়ে তাদেরকে দোকান বসাতে সুযোগ করে দেয়। আমরা কিছু বললেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে তারা অভিযোগ দেন। তখন আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দিন আহমদ বলেন, সাম্য হত্যার ঘটনায় আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তারা এরই মধ্যে ঘটনাস্থল ভিজিট করেছে এবং আজকেই বৈঠকে বসবে। তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো সব চেষ্টা করছি। আগের মতো কিছু হবে না, শেষ পরিণতি আমরা দেখবো। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বসেছি, আরও বসবো। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।