প্রথম পাতা
পিআর পদ্ধতি কতোটা যৌক্তিক?
স্টাফ রিপোর্টার
১ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবারদেশের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার বিষয় সংসদের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর)। এ ধারণার ভোটিং পদ্ধতি চেয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে জামায়াত-এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে বিএনপি এ পদ্ধতির বিরোধিতা করে প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কৌতূহল জনমনেও। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পদ্ধতি এখনই বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত নয়। এ পদ্ধতিতে সংসদে বিরোধী দলকে উপেক্ষা করার সুযোগ না থাকলেও এ পদ্ধতির নির্বাচন দুর্বল সরকার গঠনের পরিস্থিতি তৈরি করবে। যা দেশের অগ্রগতির জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হলে আগামীতে এটি অনুসরণ করা যেতে পারে।
এ পদ্ধতিতে একক রাজনৈতিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তখন জোট সরকার গঠন বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার গঠন হলে এই সরকার মাঝে ভেঙে যাওয়ারও আশঙ্কা থেকে যায়। এছাড়া বলা হচ্ছে- এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ভিন্ন কৌশলে ফিরে আসারও সুযোগ তৈরি হবে। কারণ তারা অন্য যে কোনো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নির্বাচনে নিজেদের ভোট জড়ো করার চেষ্টা চালাতে পারবে।
রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করার পর থেকেই নির্বাচন ব্যবস্থায় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি তুলেছে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল। এটি এমন এক পদ্ধতি যার মাধ্যমে নির্বাচনে যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে সে দল সংসদে তত শতাংশ আসন পাবে। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও এটির প্রচলন রয়েছে- যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ শক্তিশালী। উদাহরণ স্বরূপ কোনো দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৩০ শতাংশ ভোট পেলে সে দল সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ৯০টি পাবে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইলেক্টোরাল রি-ফরম সোসাইটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘পিআর পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে’- শীর্ষক একটি আর্টিকেলে বলা হয়, প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) নিজে কোনো নির্দিষ্ট ভোটিং সিস্টেম নয়। বরং এটি একটি ধারণা, যার উদ্দেশ্য হলো- একটি পার্লামেন্টে যেসব আসন থাকে, তা যেন ভোটের অনুপাতে বিভিন্ন দলের মধ্যে বণ্টিত হয়। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভোটিং পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে-সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট। এই পদ্ধতি বর্তমানে স্কটল্যান্ড (স্থানীয় সরকার) এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে (স্থানীয় সরকার ও বিধানসভা নির্বাচন) ব্যবহার করা হয়। এটি হচ্ছে- বড় আকারের এলাকা থেকে একাধিক প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়। ব্যালটে ভোটাররা প্রার্থীদের নামের তালিকা পান, এবং তাদের পছন্দক্রমে নম্বর (১, ২, ৩) দিয়ে ভোট দেন। একজন প্রার্থী নির্বাচিত হতে হলে নির্দিষ্ট ভোটের কোটায় পৌঁছাতে হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- অ্যাডিশনাল মেম্বার সিস্টেম। যেটি ওয়েলস পার্লামেন্ট, লন্ডন অ্যাসেম্বলি এবং স্কটিশ পার্লামেন্টে ব্যবহার হয়। এক্ষেত্রে ভোটাররা দুইটি ব্যালট পান। একটি দিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য নির্বাচন করেন। অন্যটি দিয়ে তারা একটি দলকে ভোট দেন। প্রথম ব্যালটে জয়ী ব্যক্তি সরাসরি নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় ব্যালট থেকে নির্বাচিত হয় ‘অতিরিক্ত সদস্যরা’, যাতে পুরো পার্লামেন্টে ভোটের অনুপাতে দলগুলো আসন পায়। তৃতীয়টি হচ্ছে- পার্টি লিস্ট প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন। এই পদ্ধতি সারা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয়। প্রতিটি এলাকায় একাধিক প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। দলগুলো একটি প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে। ভোটাররা হয় একটি দলকে ভোট দেন, অথবা তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের থেকে পছন্দ করেন। এক্ষেত্রে তিন ধরনের পার্টি লিস্ট পদ্ধতি রয়েছে। সেগুলো হলো- ক্লোজ লিস্ট যা ভোটার শুধু দলকে ভোট দেন; ওপেন লিস্ট যা ভোটার প্রার্থীদেরও বেছে নিতে পারেন এবং সেমি ওপেন লিস্ট যা কিছু সীমিত প্রার্থী পছন্দের স্বাধীনতা থাকে। এই পদ্ধতিতে ফলাফল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুব অনুপাতিক হয়- যত ভোট, তত আসন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারী মানবজমিনকে বলেন, এ পদ্ধতির খারাপ-ভালো দুটো দিকই রয়েছে। আমাদের মতো দেশে এটি চালু করতে কমপক্ষে ২০ বছর সময় নেয়া উচিত। যাতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয়। এটা ঠিক এ পদ্ধতি অবলম্বন করলে ছোট ছোট দলগুলো গুরুত্ব পাবে। সংসদে আসন পাবে। তখন তাদের বার্গেনিং (দর কষাকষি) বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ভোট আছে- খারাপ অবস্থায়ও এ পদ্ধতিতে ভোট হলে তারা ১০০ আসন পেয়ে যেতে পারে। তাহলে ফ্যাসিবাদকে আবার সুযোগ দেয়া হবে। ফ্যাসিবাদ শেষ হয়ে গেলে এ পদ্ধতি চালু হলে ঠিক ছিল। আস্তে আস্তে শুরু করুক। এটা এখনই করতে গেলে সমস্যা বাড়বে। নুরুল আমিন বেপারী বলেন, এ পদ্ধতিতে ভোট হলে এক একটা দল ৫টা, ১০টা করে আসন পাবে। তখন দেখা যাবে বহির্বিশ্বও তাদের স্বার্থে এদের কাজে লাগাবে। যেটি রাজনীতিকে আরও অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটি তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন আমাদের দেশের গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে। বিগত দিনে এখানে গণতন্ত্রই ছিল না। সেখান থেকে আমরা একটি জায়গায় সবাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এসেছি। কিন্তু হঠাৎ করে নতুন ঝামেলা নিয়ে আসলে সংকট আরও বাড়বে। এটা প্রতিবেশীদের একটি এজেন্ডাও হতে পারে। তাহলে তারা তাদের মতো করে এখানে কিছু আসনে তাদের লোক বসাতে পারে।
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আরেক প্রফেসর ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, এটি করার মতো অবস্থা এদেশে এখন নেই। কারণ ৫০ বছরের বেশি সময় এ দেশে এক ব্যক্তি এক ভোট সিস্টেম চলে আসছে। এর মাধ্যমে পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে এলাকার একটি যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। কিন্তু হঠাৎ করে পিআর পদ্ধতিতে এমপিদের আধিপত্যটা স্থানীয় পর্যায়ে নষ্ট হবে। তারা চাইবে না তাদের এ ক্ষমতা নষ্ট হোক। তিনি বলেন, এটার সুবিধাও আছে। যেকোনো একটা একক দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিরোধী মতকে উপেক্ষা করার সুযোগ পাবে না। দলগুলোর মধ্যে একটি বার্গেনিং ক্যাপাবিলিটি থাকতে হবে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এ সিস্টেমে ছোট দলগুলো যেহেতু ভোটের পার্সেন্টেজ অনুযায়ী সিট পাবে। তখন কোনো দল যে পরিমাণ ভোট পাবে সেটি নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা থাকে না। আর মেজেটরিয়াল সিস্টেমে এক ব্যক্তি এক ভোটে ভোটের অপচয় হয়। যেটি পিআর পদ্ধতিতে রোধ করা সম্ভব। প্রফেসর সাব্বির বলেন, এটি করার ক্ষেত্রে প্রস্তুতি ও সময়ের ব্যাপার আছে। এখনই পিআর পদ্ধতিতে গেলে বাংলাদেশে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে। এটি হলে সরকারের স্থায়ীত্ব নিয়েও আশঙ্কা থাকে। সরকার বারবার ভেঙে পড়তে পারে। এটাতে যেতে হলে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হবে। ভালো দিক হচ্ছে সবার অংশগ্রহণে সুযোগ বাড়বে রাজনীতিতে। ছোট ছোট দলের রাজনীতিতে গুরুত্ব পাবে। এ পদ্ধতিতে বিরোধী দলকে অবহেলার সুযোগ নেই। তার মতে এ পদ্ধতিতে আওয়ামী লীগ ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হবে। তিনি বলেন, এটি কোনো দলই চাইবে না। আমার মনে হয় এটা হবে না। এখন এটা সম্ভবও নয়। যারা এটি ভাবছেন তাদের হয়তো অন্যকোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।