প্রথম পাতা
ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান খালেদা জিয়ার
ফ্যাসিবাদের পতনে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার
স্টাফ রিপোর্টার
২ জুলাই ২০২৫, বুধবার
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। মঙ্গলবার বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এক আলোচনা সভায় গুলশানে ফিরোজা থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান। বেলা ৩টায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্যদিয়ে এ কর্মসূচি শুরু হয়। এরপরে জুলাই শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয়। শুরুতে অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। সভাপতির বক্তব্যের আগে নিহত ও আহতদের সম্মানে প্রত্যেকটি পরিবারের সদস্যদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে বিএনপি চেয়ারপারসনের আগে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের সামনে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার তা আমাদের দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে। যেকোনো মূল্যে বীরের এই রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারা যেন বৃথা না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। ঐক্য বজায় রাখতে হবে। আসুন আমরা সবাই মিলে শহীদ জিয়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করি, বাস্তবায়িত করি কোটি মানুষের নতুন বাংলাদেশের নির্মাণের স্বপ্নকে।
তিনি আরও বলেন, রক্তস্নাত জুলাই-আগস্ট একবছর পর আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। দীর্ঘ ১৬ বছর ফ্যাসিস্টদের নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন, গ্রেপ্তার, হত্যা, খুনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে এবং একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল আওয়ামী শাসক গোষ্ঠী। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে। সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে বাংলাদেশকে গড়বার। এই আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও আহতদের প্রতি সমবেদনা জানান বিএনপি চেয়ারপারসন।
খালেদা জিয়া বলেন, তাদের এই আত্মত্যাগ জাতি চিরকাল মনে রাখবে। গুম-খুন-বিচারবর্হিভূত হত্যার শিকার যারা হয়েছেন তাদের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি পরিবারের সম্মান এবং তাদের পুনর্বাসন এবং তাদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে।
বিএনপি গঠিত জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান, শোক ও বিজয় বর্ষপূর্তি কমিটির উদ্যোগে ‘গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪: জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও শহীদ পরিবারের সম্মানে বিশেষ এই অনুষ্ঠানের আয়োজনা করা হয়। এই কর্মসূচি উদ্বোধনীর মাধ্যমে বিএনপি’র জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪’র ৩৬ দিনের কর্মসূচি শুরু হলো। সভা শুরুর আগে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সরকারের বিরুদ্ধে ১৫ বছর আন্দোলন ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে জাতীয় ঐক্য এবং গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা স্লোগানে একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। ওদিকে সভা শুরুর আগে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিহত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন বিএনপি মহাসচিব।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ৫ই আগস্ট ভয়াবহ দানবের হাত থেকে মুক্ত হয়েছি। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, দেশকে ধ্বংস করা হয়েছে, নৈতিকতাকে ধ্বংস করা হয়েছে। তারপরেও আমরা যুদ্ধ এবং সংগ্রাম করেছি, জয়ী হয়েছি। আর সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে কখনো আপস করবে না বলেও জানান মির্জা ফখরুল।
সভায় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বিএনপি ছাড়া বড় আর কোনো দল নেই। জনগণের প্রত্যাশা অনেক বড় হয়ে গেছে। এই প্রত্যাশার জবাব দিতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, শহীদদের পরিবারের কান্নায় আজকে আমাদের চোখে পানি এসেছে। জুলাই-আগস্টে মুক্তির সনদ নিয়ে এসেছে। এই গণ-অভ্যুত্থানে বিএনপি’র অনেক অবদান, জামায়াতসহ অন্যান্য দলের অবদান রয়েছে। গুম বিএনপি’র বেশি হয়েছে। আর জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ফ্যাসিবাদের বিদায় হলেও ফ্যাসিবাদ বিলুপ্ত হয়নি।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, গত ১৭ বছর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার ভিত্তি ছিল ভীতি। এটা কোনো রাজনীতি না। এই থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আওয়ামী লীগের মতো যেন মানুষের মন থেকে ওঠে না যাই। আর আমাদের অর্জন ও স্বাধীনতা তারা এখনো মেনে নিতে পারছে না।
হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, চরম নির্যাতনের মুখে মাঠে ছিলাম, এখনো আছি। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। সেই ঐক্যে যারা ফাটল ধরাবে তারা ফ্যাসিবাদের দোসর।
বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের দাবিদার দল আওয়ামী লীগ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও আজকে এই সমাবেশের মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক জিয়াউর রহমানের দল প্রমাণ করেছে- দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র থাকবে।
রাজশাহীতে শহীদ শেখ ফাহমিন জাফরের মা কাজী মাখমিন শিল্পী বলেন, সন্তান হারানোর পরে আমি বাড়িতে থাকতে পারি নাই। তারপরেও আমরা বৈষম্যের মধ্যে আছি। এটা দূর করতে হবে। সবাই এগিয়ে আসুন, বৈষম্য দূর করুন। দেশ এখনো স্বাধীন হয় নাই।
যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ নাবিল বলেন, আজকে আমাদের চিকিৎসা হয় না, আহতদের হাসপাতালে ঢুকতে দেয় না। আমাদের একটু খোঁজখবর নেন। আমরা কি আন্দোলন করে দেশের কাছে বোঝা হয়ে গেছি।
শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, আবু সাঈদ যদি বুক পেতে না দিতো তাহলে এত সহজে আন্দোলন সফল হতো না এবং ফ্যাসিবাদের পতন হতো না।
শহীদ মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচার করবেন। নির্দোষ কেউ যাতে শাস্তি না পায়। মুগ্ধদের জন্যই এদেশ স্বাধীন হয়েছে। আগামী সরকারে শহীদ পরিবারদের অংশীদারিত্ব রাখবেন।
রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র ফারহান ফাইয়াজের বোন সায়মা ইসলাম ফারিন বলেন, জুলাইয়ের সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারছি না। আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। স্বৈরাচারী হাসিনা যেসব করেছেন, তার সবকিছুর বিচার চাই। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ দেখতে চাই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, আমার ছেলে হত্যার বিচার এখনো পাই না। দেশের পক্ষে কথা বলার জন্য তাকে হত্যা করা হয়। ভবিষ্যতে যাতে এরকম হত্যা না হয়। সেই অনুরোধ জানাচ্ছি।
বিশ্বজিৎ দাসের বাবা অনন্ত চন্দ্র দাস বলেন, আমার ছেলের হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই আপনাদের কাছে। আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে আবদুল্লাহ বিন জাহিদের মা ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, যাদের জন্য আমার ছেলে মারা গেছে, সেই সারজিস (সারজিস আলম) ও হাসনাতকে (হাসনাত আবদুল্লাহ) হাজারটা ফোন দিলেও তারা ফোন ধরে না। এখনই তারা আমাদের খোঁজ নেন না। পরে কী করবেন? বিএনপি যদি আমাদের পাশে না থাকতো তাহলে ভিক্ষা করতে হতো।
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান, শোক ও বিজয় বর্ষপূর্তি কমিটির আহ্বায়ক রুহুল কবির রিজভীর সভাপতিত্বে সভায় বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, সালাহউদ্দিন আহমেদ, অনুষ্ঠান আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান, জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, জাতীয় গণফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক টিপু বিশ্বাস, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তাহসিনা রুশদীর লুনা, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির নির্বাহী সভাপতি মাওলানা একেএম আশরাফুল হক, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব, এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমীর মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, চিকিৎসক সাখাওয়াত হোসেন শান্ত, উত্তরায় চোখে গুলিবিদ্ধ রেদোয়ান হোসেন রিয়াদ, শহীদ ওয়াসিম আকরামের বাবা শফিউল আলম, বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সহ-গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন, মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি, গুম পরিবারের সদস্য আদিবা ইসলাম রিধি, নিহত ছাত্রদল নেতা মো. নুরুজ্জামান জনির ভাই হীরা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে বিএনপি’র স্থায়ী কেন্দ্রীয় নেতাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।