প্রথম পাতা
যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক
পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে উৎকণ্ঠায় ব্যবসায়ীরা
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
১৬ মে ২০২৫, শুক্রবারমার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে, সেসব দেশের ওপর গত ২রা এপ্রিল পাল্টা শুল্ক বা রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ আরোপ করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। এতে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক দাঁড়ায় ৩৭ শতাংশ। তবে ৯ই এপ্রিল পাল্টা শুল্ক ৩ মাসের জন্য স্থগিত করেন প্রেসিডেন্ট। অবশ্য সব দেশের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর করা হয়। এতে এই ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্কের প্রভাব বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের ওপর এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। অনেক মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাড়তি শুল্কের অর্ধেকটা রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে কেটে নিচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্কের পুরোটা নেয়ার ঘটনাও ঘটছে বলে জানিয়েছেন রপ্তানিকারকরা। একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অন্যদিকে পাল্টা শুল্কের বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে- তা দৃশমান নয়। আবার ইতিমধ্যেই এক মাস পার হয়েছে। এ কারণে চিন্তিত ব্যসায়ীরা।
একাধিক উদ্যোক্তা জানান, পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগে পাওয়া ক্রয়াদেশের ক্ষেত্রেও ১০ শতাংশ শুল্কের অর্ধেক বা পুরোটা দাবি করছে মার্কিন ক্রেতারা। পণ্য রপ্তানির এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) মূল্যের সঙ্গে সেই অর্থ সমন্বয় করা হচ্ছে। তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুনাফা করতে পারছে না রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে কিছু মার্কিন পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক হ্রাস ও আমদানি বৃদ্ধির প্রস্তুতি সরকার নিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এক প্রাথমিক নথি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও কিছু পণ্য আমদানির সুযোগ রয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ সারা বিশ্ব থেকে ২.২২ বিলিয়ন ডলারের তুলা আমদানি করেছে, যার মধ্যে ৩৩৬.৫২ মিলিয়ন ডলারের তুলা এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বিশ্ববাজারে তুলা রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ ছিল ৩৫.৮১ শতাংশ। বাংলাদেশে মার্কিন তুলার ওপর কোনো শুল্ক নেই।
এর আগে গত ৫ই এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের বিষয়ে দেশটির সঙ্গে আলোচনা করেই একটা ব্যবস্থা নেয়া হবে। বলেন, ব্যাপারটা আকস্মিক নয়, আমরা এর জন্য প্রস্তুত।
জানা গেছে, ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে নতুন করে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে দেশটি থেকে আমদানি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে কিছু মার্কিন পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক হ্রাসের পাশাপাশি আমদানি বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার।
এ ছাড়া পাল্টা শুল্ক আরোপ নিয়ে দর-কষাকষি করতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে লিখিত প্রস্তাব চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তর। তারা বলেছে, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে লিখিত প্রস্তাব পেলে আনুষ্ঠানিক দর-কষাকষি শুরু হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক থেকে রেহাই পেতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ট্যারিফ লাইনে থাকা প্রায় ৪০টি এইচএস কোডের পণ্যের আমদানি বাড়ানো এবং ১০০ পণ্যে শুল্ক কমানোর জন্য খসড়া তালিকা তৈরি করেছে সরকার। তালিকা চূড়ান্ত করে শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরে পাঠানো হবে। গত ৭ই মে লিখিত প্রস্তাব চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনকে চিঠি দেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার। চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে লিখিত প্রস্তাব পেলে আনুষ্ঠানিক দরকষাকষি শুরু হবে। এর আগে গত ৭ই এপ্রিল বাণিজ্য উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পদক্ষেপ নেয়া এবং আলোচনার আগ্রহের কথা জানিয়ে জেমিসন গ্রিয়ারকে চিঠি দেন।
পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দেন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর বাজারটিতে বাংলাদেশ ৭৬০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা এ দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ১৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৭ শতাংশই তৈরি পোশাক। এই বাজারে পণ্য রপ্তানি করে ২ হাজার ৩২৬ বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান।
বাণিজ্য মন্ত্রণায়ল সূত্র জানায়, আমদানি বাড়ানো যায় এমন কিছু পণ্যের একটি খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার বিষয়েও সরকার কাজ করছে। তালিকা চূড়ান্ত করে শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হবে।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম বলেন, মার্কিন বড় ক্রেতারা ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্কের অর্ধেক এবং ছোটো ক্রেতারা পুরোটাই চাইছেন। শুল্ক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত সমস্যাটি থাকবে বলে মনে হচ্ছে।
প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, মার্কিন ক্রেতাদের কেউ ৫ শতাংশ, কেউ ১০ শতাংশ মূল্যছাড় চাইছে। তবে কোনো কোনো ক্রেতা আবার মূল্যছাড় চাইছে না। ফলে সব ধরনের ঘটনাই আছে। তবে ৫-১০ শতাংশ মূল্যছাড় দিলে মুনাফা হওয়ার সুযোগ নেই।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে কী ‘অফার’ করবে আর দেশটির কাছ থেকে কী চাইবে, সেটি আগে চূড়ান্ত করতে হবে। তারপরই আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করা দরকার। বাংলাদেশ অতিরিক্ত শুল্ক বাতিল, যুক্তরাষ্ট্রের তুলা ব্যবহারে উৎপাদিত পোশাক রপ্তানিতে শুল্কছাড় এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি আলোচনা শুরুর দাবি করতে পারে।