শেষের পাতা
‘চুরি বলবো না তবে অনেকেই দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছে’
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৩০ জুন ২০২২, বৃহস্পতিবারসরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি হচ্ছে বলে জানান সরকারদলীয় সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ। তিনি বলেন, এগুলোকে চুরি বলবো না, তবে আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেকেই দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন। দুর্নীতির বিষয়ে রাখঢাক রাখার প্রয়োজন নেই বলেই তিনি মনে করেন। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন যৌথভাবে আয়োজিত এক সংলাপে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। ‘বাংলাদেশে পাবলিক অবকাঠামো প্রকল্পের বাস্তবায়ন: অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় সংলাপে অংশ নেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির অন এস্টিমেটসের চেয়ারম্যান উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ, সংসদ সদস্য ইঞ্জি. এনামুল হক, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান প্রমুখ। আব্দুস শহীদ বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে অপচয় হচ্ছে।
প্রকল্পের পরিচালকরা এমনিতেই গাড়ি পান, এরপরও অনেক পরিচালক নতুন গাড়ি কিনছেন। এমনকি প্রকল্প এলাকায় তাকে প্রতিদিন যেতে হয় না। ফলে যেখানে তেলের দাম নিলেই যথেষ্ট, সেখানে তারা নতুন গাড়ি কিনছেন। এসব বন্ধের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ।
যে প্রকল্পের বাস্তবায়ন হার ২৫ শতাংশের নিচে রয়েছে, সেই প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা হয়। আমাদের সুপারিশগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হচ্ছেন প্রকল্প পরিচালক। কিন্তু দেখা যায় পঞ্চগড়ের কোনো প্রকল্পের পরিচালক ঢাকায় থাকছেন, এটা জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজের এলাকায় কেউ থাকতে চাচ্ছে না। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীকে পাওয়া যায় না; তাদের নাটাই ঢাকায়, কিন্তু সুতা কাটা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা সত্ত্বেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। মন্ত্রী বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের অনেক বিধি অপ্রয়োজনীয়। বৃটিশ, পাকিস্তানি ও সামরিক শাসকরা এসব করেছেন, যার এখন বাস্তবতা নেই। কিন্তু অনেক দুষ্ট আমলা এসব বিধান চাতুরীর সঙ্গে কাজে লাগাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে এসব বদলানোর, তা সত্ত্বেও এসব পরিবর্তন করা যাচ্ছে না, নানা প্রতিবন্ধকতা এসে হাজির হয়। তবে আইনকে আইন দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। আমরা সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। প্রকল্প বারবার সংশোধন নিয়মে পরিণত হয়েছে: সিপিডি জানায়, পাবলিক অবকাঠামো প্রকল্প (পিআইপি) বাস্তবায়নে বারবার সংশোধন করা একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে অবকাঠামো নির্মাণের ব্যয় বাড়ছে। ফলে প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতার ওপর সম্ভাব্য ফলাফল এবং বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এজন্য সরকারের বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগকে (আইএমইডি) শক্তিশালী করতে হবে এবং মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বিভাগীয় অফিস স্থাপন করতে হবে বলেও পরামর্শ সিপিডি’র। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১টি প্রকল্প সংশোধন করা হয়েছে। প্রকল্পগুলো সংশোধনের ফলে টাকার পরিমাণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা, পদ্মা সেতুতে যে টাকা লেগেছে প্রায় তার সমান। পদ্মা সেতুর মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
বারবার সংশোধন ও সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার ফলেই এ টাকা বেড়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে দেখি বারবার প্রকল্প সংশোধন হয়। এর ফলে সময় বাড়ানো হয়। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের কাঠামো নির্ধারণ করা গেলে অর্থ ও সময় সাশ্রয় হবে। এ ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু আমাদের জন্য বড় নজির, যা নির্ধারিত (বর্ধিত) সময়ের মধ্যে শেষ করা গেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের আরও বেশ ক’টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য আছে। তিনি বলেন, যদি সুশাসনের সঙ্গে সময়মতো বাস্তবায়ন করা যায়, সাশ্রয়ীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে দেশের জন্য মঙ্গল। এমনটা হলে আমরা আরও বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবো। তিনি বলেন, আমাদের যে অর্থ সাশ্রয় হবে, তা দিয়ে অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবো। আমরা যে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারি, তা ২৫শে জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমরা দেখছি মেগা প্রকল্প সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে খবরদারি করে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, ফলে আমরা একটা ইতিবাচক সুফল পাচ্ছি। বিষয়টি অন্যান্য প্রকল্পেও যদি কাজে লাগাতে পারি, তাহলে ১ হাজার ২৫০টি অবকাঠামো ও বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রকল্প ২০২২-২৩ সালে ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবো। প্রকল্প নিয়ে একটা কাঠামো করা যায় কি-না, তাহলে ভালোভাবে কাজ করতে পারবো।
আমাদের অর্থ ও সময় সাশ্রয় হবে। তিনি বলেন, ১০টি পিলার বা ভিতকে কেন্দ্র করে প্রজেক্ট বাস্তবায়নের গুরুত্ব দেয়া উচিত। যার মধ্যে রয়েছে অভীষ্ট লক্ষ্য ঠিক করা, এখানে কী কী ঝুঁকি রয়েছে, অবকাঠামোটি বাস্তবায়নের ফল, যথাযথ ডিজাইন, পরামর্শ প্রক্রিয়া, প্রকল্প বাস্তব জীবনে কতটুকু লাভজনক ইত্যাদি। আর প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হওয়ার পর যেন ঠিকাদার দায়বদ্ধ থাকে এমন বিষয়টি প্রজেক্টে থাকা উচিত। প্রজেক্ট পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কিনা এ বিষয়টিও নিশ্চিত করা জরুরি। তিনি বলেন, যেকোনো প্রজেক্ট বাস্তবায়নের বড় একটি সমস্যা হচ্ছে জমি অধিগ্রহণ। প্রজেক্টের সার্বিক তদারকির বিষয়টি লক্ষ্য রেখে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা জোরদার করতে হবে। সক্ষমতা অর্জনে তাদের মানবসম্পদ বাড়ানো জরুরি। ঢাকার বাইরে এই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে যেতে হবে।
বিভাগীয় পর্যায়ের অফিসের মাধ্যমে আইএমইডিকে বিকেন্দ্রীকরণ করা প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে আইএমইডি স্থাপন করার কথা বিবেচনাও করা যেতে পারে। সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক বলেন, আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, উন্নয়নের সঙ্গে মানুষের লাইফ স্টাইলের পরিবর্তন হচ্ছে। সে কারণে অবকাঠামোগত উন্নয়নের আগে সুপরিকল্পনা থাকা জরুরি। গ্রামের অনেক রাস্তা রয়েছে, সেখানে মানুষ হয়তো ভবিষ্যতে থাকবে না। আমাদের জনগণকে মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।