শরীর ও মন
আঙ্গুলের ছাপ যখন সমস্যা
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল হাই
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রবিবারতরুণটির জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল আমেরিকার কোনো বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করা। গ্র্যাজুয়েশনে নজরকাড়া রেজাল্ট ছিল। জিআরই পরীক্ষা দিয়ে আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালযয়ে লেখালেখি করতেই সে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে গেল। এবারে অ্যাম্বাসি থেকে ভিসা নেয়ার পালা। ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে গিয়েই হলো যত বিপত্তি। অনেকবার চেষ্টা করেও ডিজিটাল মেশিনে ফিঙ্গার প্রিন্ট আসেনি। অগত্যা অ্যাম্বাসি থেকে ফেরত। এভাবে আরও দু’বার বিফল যাওয়া-আসা। তৃতীয়বার তরুণটির আর এম্বাসিতে যাওয়া হলো না। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব তাকে কবরস্থানে নিয়ে গেল সমাহিত করার জন্য। ছেলেটি হতাশায় আত্মহত্যা করেছিল।
মূলত ছেলেটির ত্বকে একটি রোগ ছিল। রোগটির নাম সোরিয়াসিস। এ রোগ হলে শরীরের নানা স্থানে সাদা সাদা চামড়া ওঠে। যাদের হাত-পায়ে এ রোগ থাকে তাদেরকে একটু উন্নতমানের এবং দীর্ঘ চিকিৎসা নিতে হয়। এ চিকিৎসায় পুরোপুরি আরোগ্য না হলেও সঠিক চিকিৎসায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়। তরুণটি হয়তো সময়মতো চিকিৎসা নেয়নি এবং তার রোগের ব্যাপ্তিও তাই ছিল বেশি।
যাই হোক, আজকাল অনেক কাজেই আঙ্গুলের ছাপের প্রয়োজন হয়। পাসপোর্ট, আইডি কার্ড থেকে শুরু করে দলিল-দস্তাবেজ সবকিছুতেই আঙ্গুলের ছাপ দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অনেকের আঙ্গুলের ছাপ পুরোপুরি স্পষ্ট থাকে না বা মানসম্মত থাকে না, ফলে আঙ্গুলের ছাপ প্রত্যাখ্যান হয়। এতে মানুষকে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়। কোনো কোনো অফিসে আঙ্গুলের ছাপ দিতে ব্যর্থ হলে পুরো কাজ থেকে ছিটকে পড়তে হয়। আঙ্গুলের ছাপের বিড়ম্বনা নিয়ে ভুক্তভোগী মানুষ মাঝে মাঝে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন ।
আঙ্গুলের ছাপ প্রত্যাখ্যান হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে নিম্নোক্ত কয়েকটি কারণ:
ঘন ঘন হাত ধোয়া/জীবাণুমুক্ত করা। যে ক্রিয়াকলাপগুলোর জন্য আঙ্গুলের ডগা ব্যবহার করা প্রয়োজন, যেমন ভারোত্তোলন, রক ক্লাইম্বিং, বাগান করা বা গিটার বাজানো। কিছু কিছু রোগের কারণে হাতের ছাপ দৃশ্যমান হয় না: যেমন একজিমা, সোরিয়াসিস, জন্মগতভাবে পাতলা ত্বক, অত্যন্ত শুষ্ক ত্বক ইত্যাদি। অনেক সময় অনেক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ড্রাগের কারণে হাতে ফোস্কা উঠে বা যাদের হাত পুড়ে গেছে অতঃপর আঘাতে যাদের হাতে কার পড়ে গেছে তাদেরকে ক্ষেত্রে হাতের ছাপ পাওয়া সম্ভবপর হয় না।
ঘন ঘন বা নিয়মিত কাগজ হ্যান্ডলিং বা টাইপিং।
ব্লিচ, ক্লোরিন, অ্যাসিটোন, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল পণ্যের মতো রাসায়নিকের ঘন ঘন সংস্পর্শ।
কিছু কিছু পেশা যেমন- ডাক্তার বা নার্স বার বার হ্যান্ড স্যানিটাইজিং ব্যবহারের ফলে হাতের খাজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং একপর্যায়ে সঠিকভাবে হাতের ছাপ দেয়া সম্ভবপর হয় না। একইভাবে যারা প্রচুর কাগজের কাজ করেন তাদের হাতের খাজ অনেক সময় ক্ষয়ে যায় এবং এটা ফিঙ্গার প্রিন্টিংয়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
অনেক সময় বয়স্ক অনেক লোকের পক্ষে আঙ্গুলের ছাপ দেয়া সম্ভবপর হয় না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হাতের ত্বক মসৃণ হয়ে উঠে, ত্বকের শিরার পরিবর্তন ঘটে, ত্বকের নিচের কোলাজের ক্ষয় হয়ে যাওয়ার ফলে হাতে নতুন বলিরেখার সৃষ্টি হয়। এতে
হাতের খাজগুলো ক্যাপচার করা কঠিন হয়ে যায়।
কিছু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই সূক্ষ্ম/মসৃণ ত্বক থাকে (যেমন এশিয়ান, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, জার্মান)। তাদের পক্ষেও অনেক সময় সঠিকভাবে হাতের ছাপ দেয়া সম্ভবপর হয় না।
আঙ্গুলের ছাপের গুণগতমান উন্নত করার জন্য টিপস:
১. আঙ্গুলের ছাপ উন্নত করার সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা হলো হাত ঘন ঘন ময়েশ্চারাইজ করা। ফিঙ্গার প্রিন্টিং’র অ্যাপয়েন্টমেন্ট পর্যন্ত কয়েক দিনের জন্য প্রতিদিন অন্তত ২-৩ বার আপনার হাতে ভালোমানের ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা শুরু করুন। তবে অ্যাপয়েন্টমেন্টের দিন মশ্চেরাইজার ব্যবহার করা উচিত হবে না।
২. লাইভ স্ক্যান: অনেক জায়গায় এখনো ইনকপ্যাডের মাধ্যমে অর্থাৎ কালি ধারা আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হয়। যদি সম্ভব হয়, একটি ফিঙ্গার প্রিন্টিং সুবিধাসম্পন অবস্থান খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন, যা কালির পরিবর্তে লাইভস্ক্যান (ডিজিটাল) প্রযুক্তি ব্যবহার করে। কালি প্রিন্ট গ্রহণযোগ্য। তবে, ডিজিটাল সরঞ্জামগুলো আরও ভালো ছবি তৈরি করে।
৩. কিছুদিনের জন্য একটু বিশ্রাম বা বিরতি এ রোগের চিকিৎসায় মহা-ওষুধের মতো কাজ করে। আঙ্গুলের ছাপ নেয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পর্যন্ত কয়েক সপ্তাহের জন্য আপনার আঙ্গুলের ডগায় ঘর্ষণ বা চাপ সৃষ্টি করে, এমন কঠিন কাজগুলো এড়িয়ে চলুন। সাবান, ডিটারজেন্ট ইত্যাদি ব্যবহার বন্ধ রাখুন। আরও কিছু কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত যেমন- ক্লোরিনযুক্ত পুলে সাঁতার কাটা, ঘরদোর বা কাপড়চোপড় পরিষ্কার করা, বাগান করা, ভারী ওজনের জিনিসপত্র নিয়ে কাজ করা ইত্যাদি।
৪. কিছু কিছু রোগের ওষুধ যেমন- ক্যান্সারের কিছু কেমোথেরাপি হাতের রেখাগুলোকে অদৃশ্য করে দেয়। ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রদানের পূর্বে কয়েকদিনে ওষুধগুলো বন্ধ রাখা উচিত।
তবে সবগুলো পন্থা অবলম্বনের পরেও অনেকের পক্ষে ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রদান সম্ভবপর নাও হতে পারে। কিছু কিছু মানুষের জন্মগতভাবেই ফিঙ্গার প্রিন্ট ত্রুটিযুক্ত। যাদের কোনো অ্যাক্সিডেন্টের কারণে দুটো হাতই কাটা পড়ে গেছে সে কিভাবে ফিঙ্গার প্রিন্ট দেবে? আবার অনেকের পেশা বা দৈনন্দিন কাজের ধরনের কারণে ফিঙ্গার প্রিন্ট পরিবর্তন হয়ে যায়, ফলে তাদের পক্ষে ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রদান করা কঠিন হয়ে পড়ে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বক পাতলা হতে থাকে, রক্তের শিরাগুলো সূক্ষ্মভাবে পরিবর্তিত হয় এবং কিছু বলিরেখাও তৈরি হয়, যা আঙ্গুলের ছাপের প্যাটার্নকে ব্যাহত করতে পারে। নার্স, ডাক্তার এবং যারা পেশার কারণে অনেক বেশিবার হাত পরিষ্কার করেন, তাদের ভালো ফিঙ্গার প্রিন্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এ ছাড়াও হিসাবরক্ষক এবং যারা কাগজ নিয়ে অনেকক্ষণ কাজ করেন, তাদের প্রিন্ট কম দৃশ্যমান হয়, কারণ কাগজ আঙ্গুলের ছাপের জন্য স্যান্ডপেপার হিসেবে কাজ করে।
এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য চিকিৎসা ছাড়াও আরও কিছু পন্থা অবলম্বন করা উচিত। ফিঙ্গার প্রিন্টের পরিবর্তে অন্যান্য শনাক্তকরণ পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা করুন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে যে, যৌক্তিক কারণে আপনার আঙ্গুলের ছাপ দৃশ্যমান নয়। আপনি অনুমোদিত কর্তৃপক্ষ বা চিকিৎসক প্রদত্ত সার্টিফিকেটসহ আঙ্গুলের ছাপ থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্তির জন্য আবেদন করতে পারেন।
তবে সব সময় মনে রাখতে হবে, সঠিকভাবে হাতের ত্বকের যত্ন নিতে হবে, হাতে কোনো রোগ থাকলে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে। তাহলেই ফিঙ্গার প্রিন্টের বিড়ম্বনা থেকে অনেকটাই বেঁচে থাকা যাবে।
লেখক: (চর্ম, যৌন ও এলার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ), জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
চেম্বার-১২, স্টেডিয়াম মার্কেট, সিলেট।
ফোন- ০১৭১২২৯১৮৮৭