নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
অন্যদেশে মার্কিন হস্তক্ষেপের নীতি ও কৌশলগুলো কি এবং সেগুলো কতোটা কার্যকরী
রেজাউল করিম রনি
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শুক্রবারআমেরিকা যেটাকে দমনমূলক আচরণ মনে করে তাকে মোকাবিলা করার জন্য অন্যদেশে প্রভাব বিস্তার করাটা নিজেদের নীতিগত দায়িত্ব মনে করে। কিসিঞ্জার মনে করেন, দুনিয়ার অনেক দেশের মানুষ মুক্তির জন্য মার্কিন সহায়তা কামনা করে। অনেক দেশে আমেরিকা এটা সরাসরি করতে পারে কিন্তু এশিয়ার বেলায় এটা একটু কঠিন। সেই ক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোকে নিজেদের নিরাপত্তার দিকটির বিষয়ে সচেতন করা এবং আমেরিকান গণতন্ত্রের নীতির আলোকে তাদের দেশের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চাকে প্রভাবিত করা আমাদের ফরেন পলিসির অংশ।
আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির প্রাণপুরুষ যাকে ব্যাড বয় অব মার্কিন ফরেন পলিসি- হিসেবেও দেখা হয়। গত বছরে আয়ুর একশ’ বছর পূরণ করে মারা গিয়েছেন, খ্যাত বা কুখ্যাত হেনরি কিসিঞ্জার। ৭০- এর দশকে প্রকাশিত তার একটা বিখ্যাত বই-এর নাম ‘আমেরিকান ফরেন পলিসি’। এই বইটার আলোকে আজকে আমরা আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক আমেরিকার ফরেন পলিসির কিছু দিক দেখে নিবো।
স্যাংশন আসার পর থেকেই আমেরিকানদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছে-এমন ধারণা পোক্ত হতে থাকে। তার আগে তো আওয়ামী লীগ সরকারের বিশ্বজয়ের খবর ছাড়া আর কোনো খবর আমরা প্রচার হতে দেখি নাই। এর পরে ভিসা নীতির ঘোষণা এবং বাংলাদেশে কার্যকর গণতন্ত্র দেখতে চাওয়ার বাসনার কথা মার্কিনিদের মুখে শুনে পাবলিক নিশ্চিত হয় গোটা বিশ্ব জয় হলেও আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের জয় হয়নি। বরং তাদের বৈরিতার জন্য ক্ষমতার ক্ষয় বা পরাজয়ের অশনি ঘূর্ণিবাও বইতে শুরু করেছে। কিন্তু সরকার এই অবস্থাটা মূলত দুইটা উপায়ে মোকাবিলা করার কৌশল নেয়।
এক. যাই ঘটুক বলতে হবে আমেরিকা আমাদের সঙ্গে আছে। তারা যা করছে সবই বিরোধী দলের কাজে বিরক্ত হয়ে করছে। সেই দিক থেকেই তলে তলে সব ম্যানেজ হয়ে গেছে টাইপের কথা বাজারে রটানো হয়েছে।
দুই. আমরা আমেরিকাকে পাত্তা দেই না। আমেরিকা বাংলাদেশে পরাজিত হয়েছে। আমরা ভারত-চীন-রাশিয়া ব্লকে আছি। আমাদের পাশে বিকল্প পরাশক্তি আছে। নির্বাচনের পরে কলাম লেখা হলো- ‘নিরঙ্কুশ শেখ হাসিনা ও বাইডেনের চাপ প্রয়োগের পররাষ্ট্রনীতির পরাজয়’ (মোজাম্মেল বাবু, প্রথম আলো ৯ই জানুয়ারি ২০২৪)।
অন্যদিকে, আমেরিকা গণতন্ত্র চায় এবং বিরোধী দল গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছে। ফলে এই দুইয়ের চাওয়ার মধ্যে একটা নীতিগত ঐক্য হয়েছে বলে জনমনে একটা শক্ত ধারণা তৈরি হয়েছিল। বিন্তু সরকার ডামি পর্যবেক্ষক হাজির করে নির্বাচনের পর পরই বেশ একটা ভেল্কি দেখিয়েছে। কিন্তু আমেরিকা বলে দিয়েছে তারা কাউকে পাঠায় নাই আর নির্বাচনও গ্রহণযোগ্য হয় নাই।
সরকার ‘আমেরিকা ম্যানেজ’- এমন একটা অভিব্যক্তি প্রচার করছে আর এইসব দেখে বিরোধী শিবিরে হতাশার কালো মেঘ যেন আরও ঘন হয়ে উঠতে থাকে। আসলেই কি আমেরিকা তবে গণতন্ত্রের কথা শুধু কথার কথা হিসেবে বলেছে? ভারত যেহেতু সরকারের সঙ্গে আছে সেখানে আমেরিকা চাইলেও কি কিছু করতে পারবে? আমেরিকার সঙ্গে আন্দোলনকারীদের নীতিগত ঐক্যের কি কোনোই মূল্য নাই?
কিন্তু আসলেই আমেরিকা চাইলে তৃতীয় বিশ্বের দেশে কিছু করতে পারে কিনা? বা কীভাবে করে তা নিয়ে ভরসাযোগ্য মতামতের ঘাটতি আছে। আমরা এই বিষয়ে প্রথমে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মোরাল বা নৈতিক দিক কিসিঞ্জারের বইটা থেকে বুঝতে চেষ্টা করবো। এবং তার পরে আমেরিকা আসলেই কতোটা সামর্থ্য রাখে তাও বুঝতে চেষ্টা করবো।
ক.
Foreign policy begins where domestic policy ends.
-Henry Kissinger.
‘আমেরিকান ফরেন পলিসি’ নামক বইটার প্রথম অধ্যায়ের শুরু প্যারাতেই কিসিঞ্জার এই মন্তব্য করেন, যেখানে অভ্যন্তরীণ নীতির শেষ সেখান থেকেই বিদেশনীতির শুরু। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন পলিসির বিষয়ে যদি কোনো সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে তাতে মার্কিন দেশের স্থানীয় কোনো পরিবর্তনের সঙ্গে সেটার পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নাই। কারণ স্থানীয়ভাবে এগুলোর মীমাংসা করেই আমেরিকা তার ফরেন পলিসি রাষ্ট্রীয় নীতি আকারে প্রণয়ন করে থাকে। ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সেগুলোর পরিবর্তনের কোনো সুযোগ থাকে না।
কিসিঞ্জারের চিন্তা যেহেতু গত ৫০ বছর ধরে আমেরিকার ফরেন পলিসি নির্ধারণে অন্যতম প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছে, বলা যায় তিনি এই বিষয়ে গুরু, তার বক্তব্য আমাদের মার্কিন বিদেশনীতিটা বুঝতে সাহায্য করতে পারে। তিনি মনে করেন, আধুনিক সময়ে প্রিন্সিপাল অ্যান্ড পাওয়ার বা মূল্যবোধ ও ক্ষমতার সমন্বয়ে আমেরিকার বিদেশ নীতি পরিচালিত হয়। অর্থনৈতিক সুপ্রেমিসি বা সর্বোচ্চ ক্ষমতা ধরে রাখতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেমোক্রেসিকে তারা গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এবং বর্তমান দুনিয়াতে অন্য দেশে আধিপত্য বিস্তার করে টিকে থাকার দিন শেষ। মানে উপনিবেশের দিন শেষ। টিকে থাকতে হবে প্রভাব বিস্তার করে। আর তার জন্য মার্কিন নীতির বিস্তার ঘটাতে হবে দেশে দেশে। কেউ নিজেদের মনমতো গণতন্ত্রের মডেল চর্চা করলে সেটা আমেরিকার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। মার্কিন গণতন্ত্রের মডেলের বিশ্বায়নই আমেরিকার নীতিকে সারা দুনিয়াতে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। ভ্যালুবেইজড ‘আমেরিকান স্টাইল’ গণতন্ত্র চর্চা ছড়ানো সম্ভব হলেই আমেরিকা চলতি ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডারের’ স্পন্সর হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারবে। কিসিঞ্জার মনে করেন, মার্কিন ফরেন পলিসি বাস্তববাদী। ফলে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনে তারা মূল্যবোধকে পাশ কাটিয়ে শক্তি প্রয়োগ করতেও পিছপা হয় না। যে সব অগণতান্ত্রিক বা আমেরিকান মূল্যবোধের বিরোধী দেশের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে তাদের বিষয়ে কিসিঞ্জারের বক্তব্য হলো- রিজিওনাল পারপাস বা আঞ্চলিক প্রয়োজন ও গ্লোবাল সিকিউরিটির কথা ভেবে এটা করা হয়। এমন সময়ে নীতির চেয়ে দরকারটাকে প্রাধান্য দিয়ে অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে কাজ করা হয়।
মার্কিন দাতব্য কর্মসূচি মূলত আমেরিকান মূল্যবোধকে শক্তিশালি করার কাজ করে এবং এগুলো ফরেন পলিসির অংশ হিসেবেই করা হয়। কারণ, জনগণের সমর্থন ছাড়া আমেরিকান ফরেন পলিসি একটা দেশে প্রয়োগ করা কঠিন তাই এইড বা দাতব্য কার্যক্রম জনগণকে মার্কিন নীতি ও সুবিধার সঙ্গে পরিচিত করতে ভূমিকা রাখে।
সোভিয়েত বিপ্লবের পর থেকেই রাশিয়ার মূল্যবোধ বা মোরাল ভিত্তির সঙ্গে আমেরিকার মোরাল নীতির যে বিরোধ তার মূল্যে আছে স্বাধীনতার ধারণা ও মানবাধিকারের বিষয়টি। ফলে যেকোনো দেশে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা দিলে তা আমেরিকার জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ আকারে হাজির হয়। কারণ, রাশিয়ার নীতির পথে চলা একটা দেশে মার্কিন স্বার্থ সংরক্ষিত হতে পারে না- বলে আমেরিকা মনে করে। রুশ দেশি মোরালের বিরুদ্ধে তাই ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকার-এর বিস্তার মার্কিন ফরেন পলিসির অন্যতম কৌশল।
আমেরিকা যেটাকে দমনমূলক আচরণ মনে করে তাকে মোকাবিলা করার জন্য অন্যদেশে প্রভাব বিস্তার করাটা নিজেদের নীতিগত দায়িত্ব মনে করে। কিসিঞ্জার মনে করেন, দুনিয়ার অনেক দেশের মানুষ মুক্তির জন্য মার্কিন সহায়তা কামনা করে। অনেক দেশে আমেরিকা এটা সরাসরি করতে পারে কিন্তু এশিয়ার বেলায় এটা একটু কঠিন। সেই ক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোকে নিজেদের নিরাপত্তার দিকটির বিষয়ে সচেতন করা এবং আমেরিকান গণতন্ত্রের নীতির আলোকে তাদের দেশের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চাকে প্রভাবিত করা আমাদের ফরেন পলিসির অংশ। তাই বলে তারা যদি মনে করে, আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও অ্যাক্ট অব চ্যারিটি বা দাতব্য বিষয় তা হলে খুব ভুল বিবেচনা হবে। কারণ, দুনিয়ার নিরাপত্তা এবং একটা জাতি হিসেবে আমাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা কখনো হারতে চাই না। আমরা স্বৈরতন্ত্র ও অপশাসনের বিরুদ্ধে বিকল্প হিসেবে মার্কিন মোরাল বা মূল্যবোধের চর্চাকে প্রগতি ও উন্নতির পথে যাত্রা হিসেবে দেখি- এমনটাই মত কিসিঞ্জারের।
নোয়াম চমস্কি’র বই ‘অপটিমিজম ওভার ডেসপেয়ার’ ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গোটা ইউরোপে এবং পরে লাতিন ও এশিয়ার দেশগুলোতে আমেরিকাকে প্রভাবকের ভূমিকা নিতে দেখা গেছে। আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি কেবল এখানে উল্লেখ করবো।
চমস্কির কাছে প্রশ্নটি ছিল (সরল অনুবাদে) আমেরিকার নীতিনির্ধারকরা নয়া ওয়ার্ল্ড অর্ডার তৈরি করার জন্য গণতন্ত্রের যে ধারণাকে বুঝে থাকেন তার আলোকে আমরা কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি?
চমস্কি এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘সংক্ষেপে, ইতিহাসের এই সময়ে আমেরিকা তৃতীয় বিশ্ব ও বিশ্বের বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অঞ্চলে ইন্টারভেশন করতে গিয়ে ক্লাসিক্যাল এক সংকটে পতিত হয়েছে। এই সব জায়গায় আমেরিকার রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল। কিন্তু ‘সামরিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী। এখন একটা কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণের জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় তার দুর্বল এবং সবল অবস্থানের পর্যালোচনার উপর। এবং এই অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই অগ্রাধিকার পায় সামরিক শক্তির দিকটি এবং অর্থনৈতিক যুদ্ধের হিসাবনিকাশ। এবং এই দুই জায়গায়ই আমেরিকা সুপ্রিম ক্ষমতা নিয়ে দুনিয়াকে শাসন করে।’
খুব সরল ও সংক্ষেপে অনুবাদ করে দেখা যাচ্ছে- আমাদের আসল পয়েন্টটা আমরা পেয়ে গিয়েছি এখানে। অবশ্যই চমঙ্কি এটা আমেরিকার প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন নাই। বলেছেন সমালোচনা করতে গিয়েই। কিন্তু এই শক্তির জায়গায় আমেরিকাকে সুপ্রিম বলেই উল্লেখ করেছেন সত্যের স্বার্থেই।
আওয়ামী লীগ সরকার কেন আমেরিকাকে বাংলাদেশে তেমন পাত্তা না দিয়ে ভারতের নির্ভরতায় চরম ভূমিকায় হাজির হয়েছে? কারণ, সরকার জানে আমেরিকা এখানে রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল। এটার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় ও বাংলাদেশি মিডিয়াতে আমেরিকার অবস্থান নিয়ে ক্রমাগত মিথ্যা ও ভুয়া প্রপাগান্ডা সংবাদ ছাপিয়ে নিজ অনুসারী ও সহযোগীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার।
এই সব দেশে রাজনৈতিকভাবে আমেরিকা দুর্বল-কথাটা সত্য। চমস্কিও এটা মনে করেন। তৃতীয় বিশ্বে রাজনৈতিক ভাবে রং লোকাল মোড়লরা বেশি শক্তিশালী। কিন্তু তাই বলে সরকার কি পার পেয়ে যাবে? ইতিমধ্যে সরকার যা যা করেছে, করছে, সুপার পওয়ার হিসেবে আমেরিকার জন্য বিপুল অস্বস্তি তৈরি হওয়ার কথা। ফলে আমেরিকার এই দুর্বল রাজনৈতিক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে তার সবল দিকগুলোকেই গ্রহণ করার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। আর সেটা হলো অর্থনৈতিক যুদ্ধ। যার কিছু লক্ষণ ইতিমধ্যে আমাদের অর্থনীতিতে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের বেলায় আমেরিকার নীতি কী হতে যাচ্ছে তা পরিষ্কার এতদিনে। এখানে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন একদমই নাই। ফলে অর্থনৈতিক যুদ্ধের দিকেই এগুবে আমেরিকা। আর এতে আমেরিকার বিজয় ঠেকানোর ক্ষমতা এশিয়ার কোনো দেশের এখনো হয়ে ওঠে নাই।
লেখক: চিন্তক ও সম্পাদক, জবান।
অনেক সুন্দর করে বুঝিয়েছে ভাই। ধন্যবাদ আপনাকে, ভাল থাকবেন।।
Loud and clear।