নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
নির্বাচন, সরকার গঠন, অতঃপর
ড. মাহফুজ পারভেজ
১৩ জানুয়ারি ২০২৪, শনিবারআঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোও পূর্বতন অবস্থানের আলোকে নিজেদের অবস্থান পুনরুল্লেখ করছে। নিশ্চিতভাবেই সামনের দিনগুলোতেও বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব নিরূপণের ক্ষেত্রে ভারত, চীন, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য শক্তিসমূহ নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থের আলোকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ ও তৎপরতা অব্যাহত রাখবে
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর বিরোধিতা ও বয়কটের মুখে অনুষ্ঠিত ৭ই জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যথারীতি একতরফা বিজয় পেয়ে সরকার গঠন করেছে। নির্বাচনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ‘অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না’ বলে দাবি করেছে আর ভারত, চীন এবং রাশিয়া অভিনন্দন জানিয়েছে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে দেশ-বিদেশের বহুমাত্রিক পর্যালোচনার মধ্যে ব্যাপক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্তের বক্তব্য। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকার বলছে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে, আন্তর্জাতিক সূত্র ও সাংবাদিকেরা বলছেন ২৭ শতাংশ। কিন্তু আওয়ামী লীগপন্থি আমাদের পরিচিত অনেকে বলেছেন, ভোট পড়েছে ২০ শতাংশের নিচে। নির্বাচনের দিন ফাঁকা রাস্তা দেখা গেছে, হরতালের মতো। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকেই বলে থাকেন, গ্রামের তুলনায় শহরে ভোট পড়ে বেশি। আমার চেনাজানাদের মধ্যে খুব কম মানুষই ভোট দিয়েছেন, ১০ শতাংশের বেশি তো ভোটই দেয়নি।’
বিলাতের দ্য গার্ডিয়ানের সম্পাদকীয় নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য খারাপ দিন।’
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে দুটি ভিন্ন কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে বেশি নজর কেড়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে, ৭ই জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আলোচনা এবং কর্মের মাধ্যমে নিজের আন্তর্জাতিক সহযোগীদের নিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলোকে উন্নত করতে এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের জন্য সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। নির্বাচনের পরেও দেশের ভেতরের ও বাইরের এই পক্ষগুলো সরব রয়েছে।
এইসব পক্ষ আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কঠোর জবাব পেয়েছে। তদুপরি, পশ্চিমা চাপের মোকাবিলা করে রাশিয়া এবং চীন মার্কিন ‘হস্তক্ষেপের’ নিন্দা করেছে এবং ভারত নির্বাচনকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে অভিহিত করেছে।
নির্বাচন শেষেও দেশের ভেতরের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর এবং বাইরের পক্ষগুলোর মেরূকরণ মোটামুটিভাবে একই রয়েছে। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মহলের সক্রিয় আগ্রহের কারণ ভূ-রাজনৈতিক। ২০২০ সালেই তৎকালীন মার্কিন ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট স্টিফেন বিগান বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটি মূল অংশীদার’ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে তার অংশীদারিত্ব বাড়ানোর জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইউএস এজেন্সি অব ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-এর ২০২৩ সালের কান্ট্রি ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন স্ট্র্যাটেজিতে বাংলাদেশের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্তকারী ভৌগোলিক অবস্থান’ উল্লেখ করে। একই বছর ইউকে প্রণীত উন্নয়ন রিপোর্টে বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ‘নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়’ বলে অভিহিত করা হয়। ২০২২ সালে ঢাকায় জাপানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বাংলাদেশকে ‘ভূ-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ’ বলে অভিহিত করেন এবং গত বছর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো চীনের ‘নিয়ন্ত্রণে’ ফ্রান্সের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে ‘একত্রীকরণ’ করতে বাংলাদেশ সফরে আসেন।
প্রত্যক্ষ আঞ্চলিক প্রতিবেশী হিসেবে ভারত ও চীন বাংলাদেশকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ‘লুক ইস্ট’ এবং এখন ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির একটি মূল অংশ, যা আঞ্চলিক পরিবহন এবং ডিজিটাল সংযোগ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং শক্তি সহযোগিতার উপর জোর দেয়। বাংলাদেশ থেকে উদ্ভূত ইসলামী চরমপন্থা এবং আন্তঃসীমান্ত জঙ্গিবাদ নিয়েও ভারতের উদ্বেগ রয়েছে। এই ইস্যুতে, ভারত বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে মিত্র হিসেবে দেখে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করে। চীনও বাংলাদেশকে একটি ‘কৌশলগত উন্নয়ন সহযোগী’ বলেছে এবং বাংলাদেশের নৈকট্য এবং বঙ্গোপসাগরে কৌশলগত অবস্থানের তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছে। চীন বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে এবং মাঝে মাঝে পশ্চিমা অবস্থানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়ার অবস্থানও পশ্চিমাদের বিপরীত এবং ভারত ও চীনের অনুরূপ।
যদিও বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ বিভিন্ন বিদেশি শক্তির কাছ থেকে সাহায্য ও অংশীদারিত্ব গ্রহণ করেছে, তথাপি নানামুখী বাহ্যিক প্রভাবের মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখার এবং নির্ভরতা এড়ানোর চেষ্টা করেছে ঢাকা। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় নতুন বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার ফলে বিগত দিনগুলোতে বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর নিষ্পত্তি হয়েছে বলা যাবে না। দেশের ভেতরে ও বাইরে চলমান মেরূকরণের ফলে সৃষ্ট চাপগুলোও প্রশমিত হয়েছে বলে মনে করা ঠিক হবে না।
ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নির্বাচনের দিনই শেষ হয়ে গেছে, এমনটি নিশ্চিত হওয়ার কারণ নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা খর্ব করার এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার পথ বিঘ্নিত করার ক্ষেত্রে বিরোধীরা নির্বাচনের পরক্ষণ থেকেই বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোও পূর্বতন অবস্থানের আলোকে নিজেদের অবস্থান পুনরুল্লেখ করছে। নিশ্চিতভাবেই সামনের দিনগুলোতেও বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব নিরূপণের ক্ষেত্রে ভারত, চীন, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য শক্তিসমূহ নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থের আলোকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ ও তৎপরতা অব্যাহত রাখবে। বহুল আলোচিত-সমালোচিত নির্বাচন-পরবর্তী সরকার কীভাবে ও কী কৌশলে এই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোলযোগ এবং আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক প্রবণতা সামাল দিতে পারে এবং সর্বত্র নিজের গণতান্ত্রিক ইমেজ ও ইনক্লুসিভ চরিত্রের স্বীকৃতি আদায় করতে পারে, তার উপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যতের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
কত ভাগ ভোট পড়েছে এই নিয়ে বিতর্ক হতে পারে । তবে সংখাটা দশ ভাগের কত নিচে এটা নিয়ে মতভেদ হতে পারে । তাই যদি হয় , তবে এটা একটা গণ ভোট হয়ে গেছে এবং সরকার ক্ষমতা থাকার বৈধতা হারিয়েছেন ।