মত-মতান্তর
বিজয়ের ৫২ বছর ও তৈলাক্ত বাঁশে বানরের ওঠানামা
রফিকুজজামান রুমান
(১১ মাস আগে) ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:২৪ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৯:২৬ পূর্বাহ্ন
১৫ ডিসেম্বর রাত। আর একটু পরেই শুরু হবে ১৬ ডিসেম্বর, বিজয়ের প্রথম প্রহর। মাত্রই পান্থপথ থেকে ফার্মগেট হয়ে মিরপুর ফিরলাম। পৌষের মধ্যরাতে রাজধানীর রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি একটু কমই মনে হল। তবু মন আলোড়িত হয়ে উঠল খামারবাড়ি এসে। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের পুরো শরীরজুড়ে লাল-সবুজের বর্ণালি আলো! একটু পরেই চোখে পড়ল জাতীয় পতাকার রঙে উদ্ভাসিত জাতীয় সংসদ ভবনের নান্দনিক সাজ। আর একটু এগিয়ে এলে গণভবনের সজ্জাটিও মুগ্ধতা-ছড়ানো। চারিদিকের সাজ-সাজ রবই বলে দিচ্ছে কাল বিজয়ের দিন। স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের ৫২ বছর!
এবারের বিজয় দিবস এমন এক প্রেক্ষাপটে উদযাপিত হচ্ছে, আর ক’দিন পরেই দেশের জাতীয় নির্বাচন। স্বাধীন বাংলাদেশে ১২তম বারের মতো উদযাপিত হতে যাচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যদিও এই উদযাপন সর্বজনীন হয়ে উঠছে না বিএনপি’সহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ না করার কারণে। ক্ষমতাসীন দল যতই দাবি করুক, এই দেশে ভোট যে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করার ঐতিহ্যকে ধারণ করে, তার অনুপস্থিতি স্পষ্ট। ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতায় রেখে ভোট সুষ্ঠু হবে না বলে দাবি করা বিএনপি উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে ২০১৪ ও ২০১৮ এর নির্বাচনকে। অন্যদিকে সংবিধানকে রক্ষাকবচ বানিয়ে সেখান থেকে সরে না আসার সিদ্ধান্তে অনড় আওয়ামী লীগ যেকোনোভাবেই হোক নির্বাচন করে ফেলতে চাইছে। ২০১৪ ও ’১৮ থেকে তারাও শিখেছে। তাই এবারের নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ মরিয়া। নজিরবিহীনভাবে তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিজেদের দল থেকেই স্বতন্ত্র্য প্রার্থী দাঁড় করানোর। স্বতন্ত্র্য বা বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়ানোর সংস্কৃতি বাংলাদেশে নতুন নয়। তবে এভাবে ঘোষণা দিয়ে দলীয় সিদ্ধান্তেই স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করানোর ঘোষণা রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে সম্ভবত নতুন ‘পাঠ’ হিসেবে গণ্য হবে! এই নির্বাচনে ইতিমধ্যেই ‘ডামি’ নির্বাচন বলেও কেউ কেউ আখ্যা দিয়েছেন। বিএনপি’র নেতৃত্ব থেকে বলেই দেওয়া হয়েছে, নির্বাচনের ফলাফল চূড়ান্ত হয়েই আছে। ৭ জানুয়ারি শুধু ঘোষণা দেওয়া হবে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়াও ১৪ দলীয় জোটের আসন বন্টন নিয়েও এক ধরনের অস্বস্তি প্রকাশ করছেন জোটের শরীকরা। সাতটি আসন তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হলেও তাতে তারা খুশি নন। এই নিয়ে দর কষাকষির মধ্যেই জিএম কাদেরের জাতীয় পার্টি বরাবরের মতোই রহস্য-ঘেরা। বেশ কিছুদিন ধরেই জিএম কাদের আড়ালে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণাও তিনি দেননি। দিয়েছেন মহাসচিব। প্রধানমন্ত্রী নিজেই শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির নির্বাচনে থাকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষ দিন অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বরের পরে হয়ত অনেককিছুই স্পষ্ট হবে। শেষ পর্যন্ত যে সমীকরণেই সমাধান খোঁজা হোক না কেন, এটি স্পষ্ট যে, রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ তার পথ হারিয়েছে। ’১৪ এবং ’১৮ এর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আওয়ামী লীগকে যে অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছিল, সেখান থেকে উত্তরণের পথে না হেঁটে তারা বরং সমস্যা আরও ঘণীভূত করছে। এবারের নির্বাচনটিও যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হবে হয়ত; রাজনৈতিক দল হিসেবে তার পরাজয়ের পাশাপাশি দেশের আসন্ন সংকটের জন্যও ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতে হবে। এভাবে একটি দেশের নির্বাচন হয় না। আওয়ামী লীগ জানে কী হতে যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন জানে কীভাবে হতে যাচ্ছে, জনগণ জানে- ভোট দিতে যাক বা না যাক, আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় থাকছে। তাহলে এসব নাটক মঞ্চায়নের মানে কী? ‘বিরোধী’ দল সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করছে তাদেরকে কয়টি আসনে বিজয়ের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে! এমন নির্বাচন এই ধরাধামে সত্যিই বিরল!
অথচ আজ যে বিজয় দিবস উদযাপন করছি, ৫২ বছর আগে যে বাংলাদেশের জন্ম, তার মূলেও ছিল নির্বাচন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তার ১৬৭টি আসনের বিপরীতে ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি পায় ৮৮টি আসন। পরবর্তী ইতিহাস সবার জানা। জনরায়কে উপেক্ষা করে ভুট্টো ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। জনগণ ফুসে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে সে ক্ষোভ পরিণত হয় মুক্তি-আন্দোলনে। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ। তার মানে, নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেওয়ার মধ্যেই বাংলাদেশের মুক্তি-আন্দোলনের সূত্রপাত। নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে কী হতো সে আলোচনা এখন হয়ত প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু নির্বাচন ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। ’৭০ এর সেই নির্বাচন এর ফলাফল নিয়ে কোথাও কোনো প্রশ্ন উঠেছিল বলে শোনা যায়নি। পাকিস্তানের একটি স্বৈরশাসনের অধীনেও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি বলেই মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত প্রাণের বাংলাদেশে ৫২ বছর পরেও নির্বাচন নিয়েই দ্বিধাবিভক্ত জাতি! সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন-পদ্ধতি আজও অধরা। ‘ডামি’ প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনকে অংশ্রগহণমূলক করার প্রচেষ্টা। তাহলে আমরা কতটুকু আগালাম? ৫২ বছরে আমাদের অর্জন কী? কোনো সন্দেহ নেই, উন্নয়ন হয়েছে। চারিদিকে উন্নয়নের উজ্জ্বল উদাহরণ। কিন্তু গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ভোটাধিকার তো সবার আগে। ’৭০ এ মানুষ তো তবু ভোট দিতে পেরেছিল। এখন? ভোট কেন্দ্রে না যেতে হুকমি। মৃত মানুষের ভোট প্রদান। দলীয় প্রার্থীকে ভোট না দেওয়ার ‘অপরাধে’ ধর্ষণ-খুন। ৫৭ সেকেন্ডে ৪৩ ভোট। কতটুকু আগালাম?
ছেলেবেলায় অংক করেছিলাম। একটি তৈলাক্ত বাঁশে একটি বানর এক মিনিটে পাঁচ ফুট উপরে ওঠে। আবার পরবর্তী মিনিটে দুই ফুট নিচে নেমে যায়। তাহলে ২৫ ফুট উঁচু বাঁশের মাথায় উঠতে বানরের কত সময় লাগবে?
আমরা পদ্মা সেতু দিয়ে পাঁচ ফুট উপরে উঠি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দিয়ে মহাকাশ ছুঁই, মেট্রোরেল দিয়ে আরও পাঁচ ফুট উপরে উঠি, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, কর্ণফুলী টানেল, পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি দিয়ে আরও উপরে উঠি; কিন্তু ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পেরে যে দুই ফুট নিচে নেমে যাই, তাতে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পেতে আমাদের আর কত সময় লাগবে?
ছোটবেলায় বানরের অংকটির উত্তর পেয়েছিলাম। বড়বেলায় বাংলাদেশ নামের অংকটির উত্তর আজও মিলছে না। ২০০৮ এর পরে এদেশের কোটি তরুণ এখনও তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তাদের কাছেও বাংলাদেশ এক দুর্বোধ্য ‘অংকের’ নাম।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক
চমৎকার বাস্তুব সম্মত কথা গুলো মিলে যাচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশের সাথে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
Well expressed.
হে তরুণ লেখক, আপনার লেখাগুলো সম্পূর্ণ পরলাম খুব ভালো লাগলো। আপনি আপনার সাধ্য মতে লেকে যান আমরা পাঠক যারা আছে আপনার লেখাগুলো সম্পূর্ণ মন দিয়ে পড়ব। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
স্যাটায়ার যুক্ত বিশ্লেষণধর্মী চমৎকার লেখাটির জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, স্যার। আপনার সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলতে চাই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ভোটাধিকারের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিতে একটি দেশ যখন তার বিজয় দিবস উদযাপন করে, তখন সেখানে পুরো বিষয়টিই প্রহসনের রূপ নেয় না কি? বাংলাদেশের কোন নাগরিক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন শুধু পতাকার রঙ বদলাবার জন্য কিংবা উর্দুভাষী শোষকের পরিবর্তে বাংলাভাষী শোষক পাবার জন্য?