ঢাকা, ৬ জুলাই ২০২৫, রবিবার, ২২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৯ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

শেষের পাতা

৬০০০ সুন্দরীর রঙিন দুনিয়া

শুভ্র দেব
৭ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার

সুন্দরী তরুণী। বয়স ২৫ এর কাছাকাছি। পরনে ওয়েস্টার্ন পোশাক। নাচে, গানে ও অভিনয়ে পারদর্শী। থাকেন অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাটে। চলাফেরা করেন দামি গাড়িতে। বেশির ভাগ সময় পাঁচতারকা হোটেলে রাতযাপন করেন। সন্ধ্যার পর থেকে ইয়াবা-মদ খেয়ে ডুবে থাকেন রঙিন দুনিয়ায়। রাতভর মেলামেশা করেন বিত্তবান, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সঙ্গে। মাঝেমধ্যেই আমোদ ভ্রমণে পাড়ি জমান বিদেশে। এভাবেই কেটে যাচ্ছে তনুজার জীবন। কিন্তু তনুজা মোটেও এরকম জীবন চাননি। অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি বেছে নিয়েছেন রঙ্গিন দুনিয়া। আর প্রতি রাতেই দিচ্ছেন না বলা অনেক গল্পের জন্ম। তনুজার নিম্ন্ন-মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম হলেও বেড়ে উঠেছেন অভিজাত এলাকার সন্তানদের সঙ্গে। ভালো স্কুলে ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের পারিবারিক আর্থিক সামর্থ্য দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে চলাফেরা করা কঠিন হতো। তাদের ব্যয়বহুল জীবনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি। স্কুলের সীমানা পেরিয়ে যখন কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে যান তখন আরও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন। পরে এক বান্ধবীর মাধ্যমেই পা রাখেন এ জগতে। হয়ে যান দেহপ্রসারিণী। টাকার বিনিময়ে দেশে-বিদেশে অনেকের সঙ্গে হোটেলে, মোটেলে, রিসোর্টে ও ফ্ল্যাটে রাত কাটিয়েছেন। চাহিদা থাকায় পেতেন মোটা অঙ্কের টাকা। 

তনুজার মতো এ রকম শ’ শ’ তরুণীর রঙিন জীবন গড়ে দিয়েছেন ৫৫ বছর বয়সী নারী সামিনা আলম নীলা। গত ২৫ বছর ধরে তিনি নারী সরবরাহের কাজ করে আসছেন। এ সময়ে তিনি অন্তত ৬০০০ হাজার তরুণীকে গড়ে তুলেছেন এই ব্যবসার জন্য। বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে খদ্দের সংগ্রহ করে তিনি তাদের চাহিদা মতো তরুণীদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন ফ্ল্যাট, হোটেল ও রিসোর্টে পাঠান। অনেকেই তার কাছ থেকে তরুণীদের নিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে আমোদ-ফুর্তির জন্য নিয়ে যেতেন। বিদেশের জন্য আলাদা কিছু তরুণীদের বিশেষভাবে তৈরি করে রাখেন। বিত্তবান খদ্দের চাইলেই তাদেরকে সরবরাহ করেন। দীর্ঘদিন ধরে খদ্দেরের চাহিদামতো সুন্দরী নারী সরবরাহ করার কারণে তার আলাদা সুনাম রয়েছে। রয়েছে খদ্দের সংগ্রহ করার জন্য তার বিশাল নেটওয়ার্ক। নারী সরবরাহের এই কাজ করে তিনি কামিয়েছেন বড় অঙ্কের টাকা। তবে দুই যুগ ধরে এই ব্যবসা চালিয়ে আসতে তার বিভিন্ন ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। এক এলাকায় ব্যবসা করতে গিয়ে পড়েছেন নানা সমস্যায়। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য তিনি আবার নাম ভাঙ্গাতেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বড় কর্তাদের। এ ছাড়া সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রভাবশালীদেরও নাম ভাঙ্গাতেন। যদিও তাদের কেউই এসব বিষয় জানতেন না। বিভিন্ন সমস্যার কারণে তিনি এক এলাকায় বেশিদিন বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন না। ঘন ঘন বাসা পরিবর্তন করতেন। বিভিন্ন এলাকায় তার সুবিধামতো বাসা ভাড়া নেয়া থাকতো। অনেক ক্রেতা যখন নারীদের নিয়ে যাওয়ার স্থানের ব্যবস্থা করতে পারতেন না তখন তিনি নিজেই তার ভাড়া বাসায় সুবিধা করে দিতেন। নীলা তার সমস্ত কাজ করার জন্য একটি বড় চক্র গড়ে তুলেছেন। চক্রের সদস্যদের আলাদা আলাদা কাজ ছিল। চক্রটি নারী সরবারহ করা ছাড়া আরও বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও প্রতারণামূলক কাজ করতো। চক্রের সদস্যরা মাদক ব্যবসা, চাকরি দেয়ার নামে টাকা আত্মসাত, একান্ত সময়ের গোপন ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইলের সঙ্গে জড়িত ছিল। নীলাচক্র যেসব তরুণীদের খদ্দেরের কাছে পাঠাতো তারা নিজেও মাদক-মদসহ অনেক নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করতো। পাশাপাশি তারা নিজেরাও মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা তাদের খদ্দেরের কাছেই মাদক বিক্রি করতো। 

বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ নীলাসহ তার চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলেন- সামিনা আলম নীলা (৫৫), তাসনিয়া বেলা (১৮), মানসিব হায়াত (১৯), সৌরভ ইসলাম (২৫), সাকিব আহম্মেদ (২৭) ও চৈতি। ডিবির মতিঝিল ডিভিশন গুলশান এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেছে। ডিবির মতিঝিল বিভাগের খিলগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধোঁকা দিয়ে নারী সরবরাহ করে ব্যবসা করে আসছিল। 

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, নীলাচক্র টাকার বিনিময়ে শুধু নারী সরবরাহ করে থেমে থাকতো না। এর পাশাপাশি তারা মাদক বিক্রি করে টাকা কামাতো। এ ছাড়া যেসব খদ্দের তাদের ডেরায় আসতো তাদের মেলামেশার গোপন ভিডিও করে রাখতো। এসব ভিডিও দিয়ে ধনাঢ্য খদ্দেরের সঙ্গে ব্ল্যাকমেইল করতো। তারা এসব ভিডিও ছড়িয়ে দিবে বলে হুমকি দিতো।  খদ্দের তখন মান-সম্মানের ভয়ে তাদেরকে মোট অঙ্কের টাকা দিতো। গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছে অনেক খদ্দেরের গোপন ভিডিও পাওয়া গেছে। নীলার ডেরায় যারা আসতো তাদের সঙ্গে ভয়ঙ্কর রকম প্রতারণা করা হতো। গোপন ভিডিও দিয়ে মাসের পর মাস টাকা আদায় করা হতো। এমনকি নীলার যেসব তরুণী খদ্দেরের বাসা, হোটেল বা রিসোর্টে যেত তাদের সঙ্গেও একই প্রতারণা হতো। তরুণীরা একান্ত মেলামেশার সময় ভিডিও করে নিয়ে আসতো। পরে এসব ভিডিও পাঠিয়ে টাকা আদায় করতো। এ ধরনের শত শত অভিযোগ ডিবিতে এসেছে। 

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, গ্রেপ্তার সবাই শীর্ষ নারী সরবারহকারী। তারা একদিকে নারী সরবরাহের টাকা নেয় অন্যদিকে ইয়াবা বিক্রি করেও টাকা নিচ্ছে। তারা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বাসা ভাড়া নিয়েছে তাদের ব্যবসা চালাতো। এসব বাসার দায়িত্বে চৈতি ও সাকিব। গ্রেপ্তার মূলহোতা নীলা আমাদের জানিয়েছে, ঢাকার অভিজাত এলাকার বাসা, হোটেল, বার, রেস্টুরেন্টে নারী সরবরাহ করার জন্য এমনভাবে নারীদের সাজাতো যাতে করে যে কেউ আকৃষ্ট হয়। গ্রেপ্তার সাকিব আহমেদ সবাইকে তার পরিচয় দিতো সচিবের ছেলে হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডিজি এডমিন ছিলেন বলেও জানাতো। পরে সচিব হওয়ার পর থেকে নাকি তার বাবা সচিব কোয়ার্টারে থাকেন। বাবার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে সে গাড়িতে ফ্ল্যাগ, বডিগার্ড নিয়ে চলাফেরা করতো। পরে আমরা তদন্ত করে জানতে পেরেছি ঢাকার উঠতি বয়সী ছেলের বডিগার্ড রাখার যে অনুমতিপত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেয় সেটি সে নীলক্ষেত থেকে বানিয়ে দিতো। তিনি বলেন,  সোনালী নামের একটি মেয়ের কাছ থেকে সেনাবাহিনীতে চাকরি দেয়ার কথা বলে ১২ লাখ টাকা নিয়েছে। বিশাল নামের একজনের কাছ থেকে বডিগার্ড রাখার অনুমতিপত্র দেয়ার নাম করে ৬ লাখ নিয়েছে। অথচ সেই অনুমতি নীলক্ষেত থেকে বানিয়ে দিয়েছে। মানুষ মনে করে সে সচিবের ছেলে। অথচ তার বাবা লেখাপড়াই জানেন না। তার বাবার সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তিনিও সচিব নন বলে জানিয়েছেন। চক্রটি সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতির কাছে নারী সরবরাহ করতো বলে আমাদের কাছে স্বীকার করেছে। 

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status