শেষের পাতা
সড়ক দুর্ঘটনায় উপার্জনক্ষমদের হারিয়ে দিশাহারা ২ পরিবার
প্রতীক ওমর, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি
২২ জুন ২০২২, বুধবার
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মারা যাওয়া স্ত্রীর লাশ আনতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান স্বামী আয়নাল হোসেন। শোকের সঙ্গে যন্ত্রণায় বাকরুদ্ধ আয়নালের তিন সন্তান। তারাও বাবার সাথে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। পিতা- মাতাকে একসঙ্গে হারিয়ে আহত তিন ভাইয়ের জীবনে নেমে এসেছে বিভীষিকা। মানসিক শারীরিক যন্ত্রণা কুরে কুরে খাচ্ছে তাদের। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও তাদের পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। এমন কি যে পরিবহন তাদের সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে, সেই পরিবহনের মালিক পক্ষ থেকেও তাদের খোঁজ নেয়া হয়নি। নিহত আয়নাল হোসেনের তিন সন্তান ফরিদ হোসেন (২০), ফরহাদ হোসেন (১৮) ও ফিরোজ হোসেন (২৯)।
ঘটনার বিবরণে আয়নাল হোসেনের ছেলে ফিরোজ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, চলতি বছরের ২৫শে এপ্রিল আমার মা ফিরোজা বেগম (৪৫) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মারা যান। মায়ের লাশ একটি এম্বুলেন্সযোগে বাড়ি নেয়ার পথে বগুড়ার শেরপুরে ঘোগা সেতু নামক এলাকায় পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা শ্যামলী পরিবহনের একটি বাস এম্বুলেন্সেটিকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মায়ের লাশের সঙ্গে থাকা আমার বাবা আয়নাল হোসেন ও এম্বুলেন্সের চালক দ্বীন ইসলাম (৩৯) নিহত হন। গুরুতর আহত হয় এম্বুলেন্স সহকারী এবং আমরা তিন ভাই। ভাইদের মধ্যে ছোট ভাই ফরহাদ হোসেনের অবস্থা গুরুতর। দীর্ঘদিন বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে পায়ে অপারেশন করা হয়েছে। সে এখনো চলাফেরা করতে পারে না। মেজো ভাই ফরিদের ডান হাতে অপরারেশন করতে হয়েছে। দুই ভাইয়ের চিকিৎসা খরচ চলে যায় প্রায় দেড় লাখ টাকা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবাকে হারিয়ে আমরা এখন দিশাহারা। ভাইদের লেখাপড়াও প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। ছোট দুই ভাই এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা থাকলেও আর্থিক অনটনের জন্য হয়তো পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হবে না। আমি উপায় না পেয়ে সম্প্রতি একটি এনজিওতে ড্রাইভার হিসেবে কাজ শুরু করেছি। বাবা একজন সামান্য সবজি বিক্রেতা ছিলেন। তিনিও তেমন কোনো সম্পদ রেখে যেতে পারেননি। আমাদের এই করুণ দশাতেও শ্যামলী পরিবহনের পক্ষ থেকে কেউ খোঁজ নেয়নি। আমরা মালিক পক্ষের সঙ্গে যোগযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মালিক পক্ষের কেউ সাড়া দেয়নি। মা-বাবাকে হারিয়ে আমরা এখন চোখে অন্ধকার দেখছি। অসুন্থ দুই ভাইয়ের দেখা শোনার জন্যও কেউ নেই। দুই ভাইকে গ্রামে রেখে জীবিকার সন্ধানে আমি এখন ঢাকায়। তিনি সড়কে বেপরোয়াভাবে চলাচল করা শ্যামলী পরিবহনের মালিক পক্ষের দুষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং তাদের পরিবারের ক্ষতিপূরণের জোর দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে ঘটনার রাতেই নিহত আয়নালের মেয়ে রোজিনা বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। কিন্তু পুলিশ এই দুর্ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানালেও এখন পর্যন্ত ঘাতক বাস ড্রাইভার, হেলপার ও মালিকপক্ষকে গ্রেপ্তার করেনি।
একই ঘটনায় নিহত হয়েছেন এম্বুলেন্সের চালক দ্বীন ইসলাম (৩৯)। দ্বীন ইসলামের পরিবারে তিনিই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার ছোট দুই মেয়ে ইক্রা ইসলাম (১২) ও ইলমা ইসলাম (৩) বাবাকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। প্রতিরাতে পিতার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতো দুই বোন। এখন আর রাত নেমে এলেও বাবা বাড়ি ফেরে না। তিন বছরের ছোট্ট শিশু ইলমা বাবার খোঁজে আজও মা’কে জিজ্ঞাসা করে কেন বাবা বাড়ি ফেরে না। মেয়ের এমন প্রশ্নে নীরবে চোখের পানি ঝরান ডলি পারভীন। মেয়েদের প্রশ্নে কোনো উত্তর দিতে পারেন না তিনি।
নিহত দ্বীন ইসলামের স্ত্রী ডলি পারভীন জানান, শ্যামলী পরিবহনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত তার পরিবারের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। তিনি স্বামীর হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করে ঘাতকদের বিচার দাবি করেছেন।
এদিকে দুর্ঘটনা কবলিত এম্বুলেন্সটি ছিল ‘পিপল রিএনিমেট এন্ড এডভান্সমেন্ট কমিউনিটি’- নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের। তারা বিনামূল্যে এম্বুলেন্স সেবা দিতো। তাদের কষ্টে জোগাড় করা এম্বুলেন্সটি দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে পড়ায় তারাও সেবা দিতে পারছে না।
কথা হয় সংগঠনটির একজন স্বেচ্ছাসেবী জেহাদ খানের সঙ্গে। তিনি জানান, শ্যামলী পরিবহনটি সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে দুর্ঘটানাটি ঘটিয়েছে। এর দায়ভার তাদেরকেই নিতে হবে। কিন্তু শ্যামলী পরিবরহন দুর্ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত নিহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আমরাও একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাদের কোনো সহযোগিতা পাইনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর রোজিবুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, মামলাটির তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। আমরা আসামিদের গ্রেপ্তার করার জন্য সংশ্লিষ্ট থানাকে চিঠি দিয়েছি। শ্যামলী পরিবহনের বাসটি মালিক পক্ষ আদালতের মাধ্যমে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। তবে এম্বুলেন্সটি এখনো থানায় রয়েছে। আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছি।