শেষের পাতা
অনলাইনে রোমান্স স্ক্যাম
প্রতারণার টাকায় বাগানবাড়ি-ডুপ্লেক্স ভবন
স্টাফ রিপোর্টার
২৮ নভেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবারসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রায় অর্ধশত নারীর সঙ্গে রোমান্স স্ক্যাম ও সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার ফাঁদে ফেলে প্রতারণার অভিযোগে এক প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। গ্রেপ্তারকৃতের নাম মো. বেনজির হোসেন (৪০)। সিটিটিসি বলছে, প্রতারক বেনজির ফেসবুকে ভুয়া জৌলুসপূর্ণ প্রোফাইল তৈরি করেছে। সে নিঃসঙ্গ নারী ভিক্টিমদের টার্গেট করে প্রথমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করতো।
পরে বিয়ের প্রলোভন ও সপরিবারে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। প্রথমে বিশ্বাস তৈরি করে সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে লাখ লাখ টাকা এমনকি কোটি টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে এই ব্যক্তি। দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস নেই তার। তবুও পাঁচ বিঘা জমির ওপর তিনি গড়ে তুলেছে দোতলা ডুপ্লেক্স ভবন। সম্প্রতি আরেকটি বিলাসবহুল ভবনও কিনেছে ৩ বিঘা জমির। রয়েছে ২০ বিঘার মাছের খামারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নির্মিত আরও কয়েকটি ভবন ও বিপুল ব্যাংক ব্যালেন্স। ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে বিভিন্ন সময়ে অন্তত ৫০ নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে হাতিয়ে নেয়া অর্থ দিয়ে সবকিছু করেছে।
গতকাল ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়ে সিটিটিসি’র প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বেনজির হোসেন শাহিদ হাসান নামে আমেরিকা প্রবাসী এক বাংলাদেশি বিমান চালকের প্রোফাইল হুবহু কপি করে তার নামে একটি ফেক ফেসবুক আইডি তৈরি করে। এই আইডিটিকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য সে নিয়মিত শাহিদ হাসানের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে বিমান চালানোর ছবি ও ভিডিও পোস্ট করতো। ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ এবং পেজে নিঃসঙ্গ নারী ভুক্তভোগীদের টার্গেট করে ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করে প্রথমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে পরে বিয়ের প্রলোভন ও সপরিবারে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতো।
সে অডিও কলে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বললেও নানান অজুহাতে কখনোই ভিডিও কলে কথা বলতো না। একপর্যায়ে সে বিভিন্ন সময় বিপদে পড়ার কথা বলে তার দেয়া বিভিন্ন নগদ নম্বরে (প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা ১৯টি নগদ নম্বরের বিষয়ে জানা গিয়েছে) ধাপে ধাপে লাখ লাখ টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছে। বেনজির হোসেনের প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১৩টি নগদ নম্বরে গত ৪ মাসে ১ কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।
সিটিটিসি’র প্রধান বলেন, বেনজির নড়াইল জেলায় নিজের বাড়িতে থেকে প্রতারণার কাজ করলেও ক্যাশ আউট করতো তার বাড়ি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে যশোর ও খুলনা জেলায় বিভিন্ন নগদ ক্যাশ আউট পয়েন্টে। তার প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত সিম এবং নগদ নাম্বারের রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত এনআইডি অন্য ব্যক্তির নামে। ক্যাশ আউট করার সময় প্রতারক বেনজির হোসেন পরিচয় ও চেহারা গোপন করার জন্য ক্যাপ, সানগ্লাস ও মুখে মাস্ক পরে থাকতো।
তিনি বলেন, একজন ভিক্টিম একজন সিঙ্গেল মাদার। বেনজির হোসেনের প্রতারণার শিকার হয়ে গত ৭ মাসে বিভিন্ন নগদ নম্বরে প্রতি মাসে ১৪-১৫ লাখ করে টাকা দিয়ে প্রায় ১ কোটি টাকা খুইয়েছেন। একই সময়ে অপর একজন ভিক্টিম জান্নাত (ছদ্মনাম) বেনজির এর কাছে খুইয়েছেন ১৫ লাখ টাকা। তার স্মার্ট ফোনে ৫০ এরও অধিক ভিক্টিম এর সন্ধান পাওয়া যায়। এই দুই ভুক্তভোগীর গত এক সপ্তাহের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অভিযোগ নিয়ে সিটিটিসি সাইবার টিম তাদের মামলার পরামর্শ দেয় এবং ছায়া তদন্ত শুরু করে। ভুক্তভোগী স্বপ্না রাজধানীর ওয়ারী থানায় প্রতারণার বিষয়ে ২১শে নভেম্বর মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে ২২শে নভেম্বর ছায়া তদন্তে নেমে বিশদ প্রযুক্তিগত অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে বেনজির হোসেনকে শনাক্ত করে খুলনার ফুলতলায় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত নগদ নম্বর থেকে ক্যাশ আউটের সময় সন্ধ্যায় হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বেনজির এইচএসসি পাস করে চাকরিতে যোগ দেয়। চুরির দায়ে সেই চাকরি চলে যায় তার। সে খুবই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার পিতা সেই অঞ্চলের বিভিন্ন হাটবাজারে তালের শাঁস বিক্রি করতো। তবে খুব মেধাবী ছিল। তার বৈধ কোনো পেশা নেই। তার মূল পেশাই প্রতারণা। এলাকার সাধারণ মানুষ সন্দেহ করলেও নানা অপরাধে জড়িত থাকায় কেউ কিছু বলতো না। একজনের অভিযোগের ফলে আমরা তাকে গ্রেপ্তার করেছি। তার প্রতারণার শিকার অসংখ্য নারী। তার প্রতারণার শিকার হয়ে এক নারী আত্মহত্যাও করেছে। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে আপত্তিকর ছবিও সংগ্রহ করতো। অনেক ভুক্তভোগী মানসম্মানের ভয়ে প্রকাশও করতে চায় না।