শরীর ও মন
কোলোরেক্টাল ক্যান্সার, ঝুঁকি কমানোর প্রক্রিয়া
ডা. মোহাম্মদ তানভীর জালাল
১৯ নভেম্বর ২০২৩, রবিবারকোলোরেক্টাল ক্যান্সার বা মলাশয়ের ক্যান্সার (Colorectal Cancer) হলো- একটি সাধারণ ধরনের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ক্যান্সার। প্রধান কারণ হলো কোলন বা মলদ্বারে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। দুনিয়াজুড়ে, কোলোরেক্টাল ক্যান্সার পুরুষদের মধ্যে তৃতীয় সর্বাধিক সাধারণ ক্যান্সার। মহিলাদের মধ্যে তা দ্বিতীয় সর্বাধিক সাধারণ ক্যান্সার। ২০১৮ সালে, ১.৮ মিলিয়নেরও বেশি নতুন কোলোরেক্টাল ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়েছে সব বয়সের পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে।
শুধু সচেতনতার অভাবে বর্তমানে বাংলাদেশে কোলোরেক্টাল ক্যান্সারে আক্রান্তের হার অতিমাত্রায় বেড়ে চলেছে। তাই এই হার বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার জন্য সচেতনতার ও এ রোগ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা অর্জন খুবই দরকার।
কোলোরেক্টাল ক্যান্সার কি? (What is colorectal cancer)
কোলোরেক্টাল ক্যান্সার হয় যখন কোলন বা মলদ্বারের আস্তরণের কোষগুলো বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এবং তা অস্বাভাবিকভাবে বিভাজিত হয়, যা টিস্যুগুলোর উপর প্রভাব ফেলে, যা পলিপ নামে পরিচিত। সমস্ত পলিপ ক্যান্সারযুক্ত নয়, তবে যেগুলো বাড়তে থাকে তা ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে।
এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিভাজনের পিছনে সঠিক কারণ অজানা, তবে গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে, এই কারণগুলো একটি ভূমিকা পালন করতে পারে:
# বয়স # পারিবারিক ইতিহাস
# স্থূলতা # লাল মাংসের উচ্চ ভোজন
# ধূমপান # অ্যালকোহল গ্রহণ
# কিছু চিকিৎসা শর্ত
কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের সঙ্গে যুক্ত সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
# মলের মধ্যে রক্ত # আলগা মল বা কোষ্ঠকাঠিন্য
# পেটে ব্যথা বাক্র্যাম্প # ক্লান্তি
# অসম্পূর্ণ অন্ত্র খালি করা
# অনিচ্ছাকৃত ওজন হ্রাস
এই লক্ষণগুলো বিভিন্ন গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল মেডিকেল অবস্থার সঙ্গে ওভারল্যাপ করে। এবং তাই, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোলোরেক্টাল ক্যান্সার উন্নত পর্যায়ে নির্ণয় করা হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে কোলোরেক্টাল ক্যান্সার নির্ণয় করা এবং পরিচালনা করা চিকিৎসার ফলাফল এবং জীবনের মান উন্নত করার সর্বোত্তম উপায়। প্রাথমিক পর্যায়ে কোলোরেক্টাল ক্যান্সার শনাক্তকরণ এই ক্যান্সারগুলোর জন্য নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে।
কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের জন্য স্ক্রিনিং নির্দেশিকা (Screening Guidelines for colorectal cancer)
আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির মতে, যাদের কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের গড় ঝুঁকি রয়েছে তাদের ৪৫ বছর বয়সে স্ক্রিনিং শুরু করা উচিত। কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের জন্য স্ক্রিনিং হয় একটি স্টুল-ভিত্তিক পরীক্ষা বা ভিজ্যুয়াল পরীক্ষার মাধ্যমে করা যেতে পারে।
যাদের স্বাস্থ্য এবং আয়ু ভালো তারা ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্ক্রিনিং চালিয়ে যেতে পারেন। ৭৬ থেকে ৮৫ বছর বয়সের লোকেরা যদি স্ক্রিনিং চালিয়ে যেতে চান, তাহলে তাদের অবশ্যই সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একজন ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের জন্য বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিনিং পদ্ধতি
মল-ভিত্তিক পরীক্ষা (Stool-based tests):
এগুলো অ-আক্রমণাত্মক পরীক্ষা যেখানে মলের একটি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের লক্ষণগুলো দেখতে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়। যেমন মলের মধ্যে রক্ত দেখা যাচ্ছে কিনা।
মল পরীক্ষাগুলো আরও নিম্নলিখিত প্রকারে বিভক্ত:
Faecal immunochemical test (FIT) বা Immunochemical faecal occult blood test (iFOBT): এই পরীক্ষায়, মলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রক্তের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। মলের রক্ত পলিপ বা ক্যান্সার নির্দেশ করতে পারে। এই পরীক্ষা প্রত্যেক বছর করা উচিত।
Guaiac-based faecal occult blood test (gFOBT): এই পরীক্ষায়, মলের নমুনা একটি বিশেষ কার্ডে পরীক্ষা করা হয় যা মঁধরধপ (একটি উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত পদার্থ) দিয়ে লেপা। যদি মলের নমুনায় রক্ত থাকে, তবে কার্ডটি তার রঙ পরিবর্তন করে। এই পরীক্ষা প্রতি বছর করা উচিত।
Stool DNA test: এই পরীক্ষাটি মলের নমুনার কোষে ডিএনএ পরিবর্তন শনাক্ত করে এবং কোলন ক্যান্সার বা পলিপের সঙ্গে সম্পর্কিত অস্বাভাবিক ডিএনএ সন্ধান করে। পরীক্ষাটি মলের মধ্যে লুকানো রক্তও শনাক্ত করে, যা ক্যান্সারের উপস্থিতি নির্দেশ করতে পারে। এই পরীক্ষা প্রতি ৩ বছর পর করা উচিত।
সরাসরি ভিজ্যুয়ালাইজেশন স্ক্রিনিং (Direct visualisation screening):
নিম্নলিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে সরাসরি ভিজ্যুয়ালাইজেশন স্ক্রিনিং করা যেতে পারে:
কোলনোস্কোপি (Colonoscopy): এই পরীক্ষায়, ডাক্তার একটি কোলোনস্কোপ দিয়ে কোলন এবং মলদ্বারের সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য দেখেন। যা একটি নমনীয় টিউব যার শেষে একটি হালকা এবং ছোট ভিডিও ক্যামেরা থাকে। বায়োপসি নমুনা নেয়ার জন্য বা প্রয়োজনে পলিপের মতো সন্দেহজনক জায়গাগুলো অপসারণ করতে বিশেষ যন্ত্রগুলো কোলোনোস্কোপের মাধ্যমে পাস করা যেতে পারে। কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের গড় ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের জন্য প্রতি ১০ বছরে কোলনোস্কোপি করা হয়।
কোলোনোস্কোপি
কোলোরেক্টাল ক্যান্সার প্রতিরোধ (Prevention of Colorectal Cancer)
কোলোরেক্টাল ক্যান্সার প্রতিরোধের বিশেষ কোনো উপায় নেই। কিন্তু, নিচের প্রদত্ত ব্যবস্থাগুলো অনুসরণ করলে এর ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে:
ডায়েট
# রেড মিট খাওয়া এড়িয়ে চলুন। গবেষণা অনুসারে, লাল মাংস খেলে কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি ২২ পারসেন্ট বৃদ্ধি পায়।
# অ্যালকোহল সেবন সীমিত করুন বা ছেড়ে দিন। অ্যালকোহল সেবন কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি ৮% বাড়িয়ে দেয়।
# ধূমপান ত্যাগ করুন। ধূমপায়ীদের অ্যাডেনোমেটাস পলিপ এবং কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি ১১৪% বেশি।
জীবনধারা
# ওজন বেশি হলে ওজন হ্রাস করুন।
# নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
# উচ্চ ফাইবার খাদ্য কোলন/মলাশয় ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিনের ডায়েটে উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার এবং স্যালাডের ব্যবহার প্রতিদিনের খাবারে ফাইবার সামগ্রী বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (কোলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগ) কোলোরেক্টাল, লেপারোস্কপিক ও জেনারেল সার্জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
চেম্বার: ১৯ গ্রীন রোড, এ কে কমপ্লেক্স, লিফ্ট-৪, ঢাকা। ফোন-০১৭১২-৯৬৫০০৯