মত-মতান্তর
শ্র দ্ধা ঞ্জ লি
চিরতরুণ আসাদ চৌধুরী
ফরিদুর রেজা সাগর
৬ অক্টোবর ২০২৩, শুক্রবার
সর্বজনের প্রিয় কবি আসাদ চৌধুরী। আমার মা রাবেয়া খাতুনের প্রিয় কবি তিনি। আমি তাকে ‘আসাদ ভাই’ সম্বোধন করি। মুখে সারাক্ষণ হাসি। কথা বলেন বিশুদ্ধ উচ্চারণে। এখন তার এক মুখ দাঁড়ি। পরনে চিরন্তন বাঙালি পোশাক। পায়জামা পাঞ্জাবি। শীত এলে কাঁধে উত্তরীয়। কবি হিসেবে তার খ্যাতি সবাই জানেন। একাত্তরের শব্দসৈনিক। ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী।
টিভি ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আসাদ ভাই অনেক বড়। বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম যুগ থেকেই শিল্প সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠান করে যাচ্ছেন। তার উপস্থাপনায় একটি বিখ্যাত অনুষ্ঠানের নাম ‘প্রচ্ছদ’। এই অনুষ্ঠানে প্রিয় কবি আসাদ ভাই একজন চিত্রশিল্পীর পরিচিতি তুলে ধরতেন। তখনকার কালের তরুণ শিল্পীদের কর্ম ও সাফল্য নিয়ে থাকতো ছোট্ট একটা সাক্ষাৎকার। আর শিল্পীর ওপর নির্মাণ করা হতো প্রামাণ্যচিত্র।
‘প্রচ্ছদ’ অনুষ্ঠানেই প্রথম হারানো দিনের গান প্রচার শুরু হয়। হারানো দিনের গান শব্দটিও আসাদ ভাইয়ের দেয়া। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও নিঝুর গাওয়া একটি রবীন্দ্রসংগীত প্রথম প্রচারিত হয় এই ‘প্রচ্ছদেই’। কাদেরী কিবরিয়া, সাবিহা মাহবুব, সাদী মহম্মদ, লিলি ইসলাম প্রমুখের গাওয়া হারানো দিনের গানের স্মৃতি এখনো টিভি দর্শকদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ‘প্রচ্ছদ’ অনুষ্ঠানে আসাদ ভাই নিয়মিতভাবে প্রতি পর্বে স্বরচিত কথিকা ও ছড়াপাঠ রাখতেন। আসাদ ভাইয়ের পরে এমন ধারার অনুষ্ঠান আর হয়নি।

আমরা চ্যানেল আইয়ের মাধ্যমে চেষ্টা করেছি। আসাদ ভাই নিজেই সে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা সফল হতে পারিনি। আসাদ ভাইকে অনুষ্ঠান নির্মাণের চাহিদা মতো সুযোগ-সুবিধা হয়তো দিতে পারিনি।
কবি আসাদ চৌধুরীর অনেক পরিচয়। তার আরেকটি বড় পরিচয় তিনি চ্যানেল আই পরিবারের একজন সক্রিয় সদস্য। বহু ধরনের অনুষ্ঠান তিনি চ্যানেল আইতে উপস্থাপনা করেছেন। পরিকল্পনা করেছেন। চ্যানেল আইতে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বিষয়ক অনেক আনন্দঘন অনুষ্ঠান তিনি উপস্থাপনা করেছেন। আমাদের রবীন্দ্রমেলা, নজরুলমেলা, বিজয়মেলা, প্রকৃতিমেলাতে উদ্বোধক থেকেছেন বহুবার।
উদ্বোধনী বক্তব্য রেখেছেন। আর যেকোনো বিপদে পড়লেই আসাদ ভাই আমাদের কাণ্ডারি। কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার, কারও স্মরণে কোনো অনুষ্ঠান-আসাদ ভাই ছাড়া আমাদের উপায় নাই। আসাদ ভাই সবসময় তার উদার মনটি আমাদের জন্য প্রসারিত রেখেছেন।
আর তৃতীয় মাত্রার কোনো বিশেষ পর্বে আসাদ ভাই যখন আলোচক থাকেন অনুষ্ঠান তখন হয় প্রাণবন্ত। সেদিন এক তৃতীয় মাত্রায় বিজয় দিবসের বিশেষ পর্ব রেকর্ডিং হচ্ছিল। আমি ছিলাম উপস্থাপনায়, শেষে আমি বললাম আজকের তৃতীয় মাত্রার সমাপ্তি টানবেন কবি আসাদ চৌধুরী। আসাদ ভাই তখন ভারী গলায় বললেন মুক্তিযুদ্ধের শেষ নাই। এই আলোচনা চলতেই থাকবে অনন্তকাল। আসাদ ভাইয়ের চোখ ছলছল। আমারও।
হাজার হাজার স্মৃতি আছে আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে। একদিনের কথা- আমার মা রাবেয়া খাতুন কবি আসাদ চৌধুরীকে বই উৎসর্গ করেছেন। আমীরুলকে সঙ্গে নিয়ে আম্মা গেলেন আসাদ ভাইয়ের বাসায়। উৎসর্গ পেয়ে শিশুর মতো হয়ে গেলেন তিনি। সে কী উচ্ছ্বাস তার।
আম্মাও খুব খুশি হয়েছিলেন। অনেককে সেই গল্প বলে আনন্দ পেতে দেখেছি আম্মাকে। দেশে এলে এক অনুষ্ঠানের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম কবি আসাদ চৌধুরীকে। দু’দিন বাদে আমীরুল জানালো আসাদ ভাইয়ের শরীর খারাপ। কিন্তু আমি মানতে পারলাম না। শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে আসাদ ভাই অনুষ্ঠানে আসবেন না- এমনটা হতেই পারে না।
কিন্তু হায়! খবরটা শুনে হৃদয় ভেঙে গেল। কানাডা থেকে খবর এলো আমাদের প্রিয় আসাদ ভাই কানাডার ‘অসোয়া লেক রিচ হাসপাতালে’ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় বেলা ১২টায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমালেন ওপারে।
আসাদ ভাই আর আসবেন না তার প্রিয় চ্যানেল আইতে। হাসিমুখে বলবেন না সাগর, কেমন আছো, নিজের শরীরের যত্ন নাও।
আপনার অভাব পূরণ হবার নয় আসাদ ভাই...।
পাঠকের মতামত
Allah Rabbul AlAmin keep him in eternal peace...