ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

ছাত্রলীগ-ছাত্রদল: সমাজ-ভিত্তিক রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্র-ভিত্তিক সমাজ

ইফতেখার আহমেদ খান

(১ বছর আগে) ১০ জুন ২০২২, শুক্রবার, ৯:২০ অপরাহ্ন

mzamin

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অব্যবহিতকালেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি উদ্ভবগত উদ্দেশ্যে পরিচালিত হওয়ার পথে বাঁক বদলায়। শুরুর কালেই সামরিক শাসন-এর সমাজ-ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্র বদলে একে পুরোমাত্রায় রাষ্ট্র-ভিত্তিক সমাজের ভাবধারায় নিয়ে যায়। রাষ্ট্রের পরিচালকগণ তাদের স্বীয় আদর্শ চাপিয়ে দেন সমাজের ওপর, সমাজ তার নিজস্ব আদর্শ বিসর্জন দিয়ে অজ্ঞাতেই পরিচালকগণের অনুঘটকে পরিণত হয়। সাম্প্রতিক শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল ঘটনাটির মূলে এই কারণই কাজ করেছে। হান্টিংটন তার রাজনৈতিক উন্নয়ন তত্ত্ব বিশ্লেষণে কমপ্লেক্স সংগঠন বলে একটি প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি এর সঙ্গে যুক্ত করেন প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাত্রা (Level of Institutionaliæation) অর্থাৎ, একটি রাজনৈতিক সংগঠন কী মাত্রায় তাদের কর্মসূচিতে জনস্বার্থ অর্ন্তভুক্ত করতে পেরেছে। একটি সংগঠন তার মূলকাঠামোর বাইরে যে সকল অঙ্গ-সংগঠন রয়েছে সেরকম সংগঠনকে কমপ্লেক্স সংগঠন বলেছেন। যেমন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, এর রয়েছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ, তাঁতীলীগ, শ্রমিকলীগ ইত্যাদি। সেই সূত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি কমপ্লেক্স সংগঠন, যার রয়েছে অত্যন্ত পোক্ত গণভিত্তি। অন্যদিক, বিএনপিরও অনুরুপ অঙ্গ-সংগঠন রয়েছে, সেটিও একটি কমপ্লেক্স সংগঠন।

বিজ্ঞাপন
উভয় সংগঠনেরই ছাত্র শাখাটি বেশ শক্তিশালী। এর কারণ কী? এর কারণ হলো- ছাত্ররা সচেতন, তথ্যভিত্তিক ও সংগঠিত। মূলে আরেকটি মৌলিক কারণ রয়েছে, সেটি হলো- ছাত্রছাত্রীরা এখনও প্রায় পুরোমাত্রায় বস্তুজগতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বস্তু বা বাস্তবতা এখনও তাদের ওপর সেভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারেনি। খুব কমসংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে বস্তুভাবনায় ক্লান্ত হতে হয়, এ কারণেই তারা আবেগী হয়, স্পর্শকাতর হয়- যারই সুযোগ নেয় রাষ্ট্রপরিচালকগণ। প্রধানমন্ত্রীর একটি কথার সূত্র ধরে ঘটিত মহাকান্ডটি বিশ্লেøষণের জন্য আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ব্যাখ্যা করতে হবে।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকরণটির দিকে লক্ষ্য করলে যে চিত্র দেখা যায় তা খুব হতাশাজনক। একটি অংশ মনে করে রাজনীতির উদ্দেশ্য এবং এইভাবে বাংলাদেশের উদ্দেশ্য মানে হলো ধর্মভিত্তিক সমাজ গড়া- তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধর্মভিত্তিক, একটি অংশ মনে করে রাজনীতির উদ্দেশ্য শ্রেণির বিলোপ করে শ্রেণিহীন সমাজ কায়েম করা- তাদের সংস্কৃতি সাম্যবাদী ও ধর্মমুক্ত, একটি অংশ মনে করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব এবং বিকাশই হলো রাজনীতির উদ্দেশ্য। তারা উদার ও ধর্ম নিরপেক্ষ, একটি অংশ মনে করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সংশ্লিষ্ট জিন্দাবাদ প্রতিষ্ঠাই হলো রাজনীতির উদ্দেশ্য- তারা ধর্মাশ্রয়ীভাবে রক্ষণশীল। এতোটা আপাত-বিরোধী রাজনীতির ধারা একটি দেশের রাজনীতির পরিমন্ডলকে নিয়ে যায় এসি ফাইনারের নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি (Lwo Political Culture) ও ওয়ালটার রজেনব্যাম এর বিখন্ডিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির (Fragmented Political Culture) ধারায়। বস্তুত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভয়ঙ্কর রকমের ভিন্নতা দেশটিকে পতিত করে গভীর সংহতির সংকটে (Integration Crisis)। এই সংহতির অভাব থেকেই ঘটে এরকম ঠুনকো রাজনৈতিক কর্মসূচি। পানিতে ফেলে দেয়া হবে কিংবা পানিতে চুবিয়ে তোলা হবে এবং এটাকে কেন্দ্র করে এই মহড়া ও মহাউল্লাস কোন আধুনিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারে না। এলমন্ড এবং পাওয়েল-এর কাঠামো-কার্যগত তত্ত্ব (Structural Functional theory) বলে দেয় একটি আধুনিক রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি-অনুসূচির প্রবাহটি। এই তত্ত্বের একটি সরল বিশ্লেষণ হলো- একটি রাজনৈতিক দল সমাজের বৃহত্তর অংশ হতে সমাজের প্রয়োজন সংগ্রহ করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই সব প্রয়োজন মিটাবে- এটিই আধুনিক রাজনৈতিক দলের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। সেই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলকে হতে হবে নিরপক্ষে, কোন নির্দিষ্ট ধর্ম কিংবা গোত্রের কিংবা অংশের প্রতিনিধিত্ব রাজনৈতিক দল করে না, রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে সর্বজনীনভাবে সকলজনগোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। তার অঙ্গ-সংগঠনের মাধ্যমে একটি বিকশিত রাজনৈতিক দল অনুরুপ কার্যই সম্পাদন করে। যেমন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বিষয়টি এমন নয় ছাত্রলীগের সদস্য নয় এমন কোন ছাত্রের ন্যায়ত প্রয়োজনের দিকে সে হাত বাড়াবে না কিংবা একদল রাজনীতি নিরপেক্ষে ছাত্র কোন ন্যায্য দাবির জন্য সংহত হয়েছে তাদের প্রতি একাত্মতা পোষণ করবে না। ছাত্র রাজনীতি মূলত ব্যক্তির রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের একটি ব্যবহারিক ধাপ যা ব্যক্তির মধ্যে অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে এবং যেটা তাকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ভিতকে মজবুত করার প্রেক্ষিতে নিয়ে যায়। বলা প্রয়োজন, প্রত্যক্ষভাবে ছাত্ররাজনীতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি-মানুষ রাজনীতির প্রক্রিয়া- প্রবাহ এবং অন্তর্গত দর্শন সম্বন্ধে মৌলিক ধারণার অধিকারী হয়। আমরা যদি সভ্যতার বিবর্তনের ধারাবাহিকতা দেখি। তবে দেখা যায় সামন্তসমাজের পরবর্তী ধাপটি হচ্ছে আধুনিকতা। যে সকল উপাদান বা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সামন্তসমাজ থেকে আধুনিক সমাজের তফাৎ ধরা হয় সেগুলোর মধ্যে প্রধানতমটি হলো গণতান্ত্রিক শাসনের আর্বিভাব। আর গণতান্ত্রিক শাসন গড়ে তোলার একমাত্র মাধ্যম হলো রাজনৈতিক দল, সুতরাং দেখা গেল রাজনৈতিক দল হলো আধুনিক শাসন বা রাজনীতির জননী। একটি সুষ্ঠ দলীয় ব্যবস্থাই একটি সনাতন সমাজকে আধুনিকতার পর্বে নিয়ে যায়। রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার শর্ত রয়েছে। যেমন, যেসকল সমাজের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ-এর উদ্ভব ও বিকাশ রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রার সঙ্গে সমানতালে চলতে পারে না, সে সকল সমাজে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপস্থিতি সন্তোষজনক মাত্রায় পরিলক্ষিত হয় না। রাজনীতিতে জনগণের বিকাশমান অংশগ্রহণের প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক উপায় হচ্ছে রাজনৈতিক দল ও দলীয় ব্যবস্থা।

আধুনিক সমাজে রাষ্ট্র-গঠন বলতে কেবল পোক্ত প্রশাসন কিংবা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা বুঝায় না, রাষ্ট্র-গঠন হলো সেই বিষয় যেখানে সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন গোষ্ঠীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণের কাঠামো নির্মাণে সামর্থ্য হয়, সেই কাঠামোটিই হলো দল ও দলীয়ব্যবস্থা। রাজনৈতিক দল রাজনীতিতে জনসাধারণের অংশগ্রহণের কাজ সংগঠন করে, রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণ যে হারে বৃদ্ধি পায় তা পুরোপুরি দলীয়ব্যবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়। দলীয় নেতৃবৃন্দ দলীয় কাঠামোর ভিতর রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণ সংগঠিত করতে নির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে প্রচারণা চালায়। এই নীতি অবশ্যই হতে পারে চলমান শাসনের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, অনু-সিন্ধান্ত, প্রক্রিয়া কিংবা পদ্ধতির বিরুদ্ধতা, কিন্তু তা কখনোই সেই রাষ্ট্রের উদ্ভবের উদ্দেশ্য, রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি ও আদর্শের বিপরীত পরিক্রমায় হবে না। কোন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল না থাকলে সেখানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধনের এবং এইরুপ পরিবর্তনের ফলাফলকে সঠিক খাতে বাহিত করার কোন প্রাতিষ্ঠানিকমাধ্যম আর থাকে না। ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী মরিজ দুভারজার মন্তব্য করেন- রাজনৈতিক দলবিহীন সরকার অবশ্যই রক্ষণশীল সরকার। তার বক্তব্যের আরও সরল প্রকাশ হলো- রাজনৈতিক দলবিহীন সরকার পূর্বতন সেই সামন্ত-সরকার যেটি মূলত সরকার নয়, সেটি শাসক এবং যা আধুনিকতার বিপরীত প্রপঞ্চ। এই বিষয়টির আলোকে যদি বাংলাদেশের রাজনীতি মূল্যায়ন করা হয় তবে নিশ্চই অনুধাবন করা যায় একটি প্রকৃত প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক দলকে কতটুকু বিবেচনাপ্রসূত এবং জ্ঞানভিত্তিক হতে হবে। রাজনৈতিক আচার ও শিষ্টাচার, আদর্শ ও কর্মসূচি, সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি সকল কিছুতে অঙ্গ-সংঠনসমূহের সম্পৃক্ততা অবশ্যই রাজনীতির উপাদান কিংবা বিষয়সংশ্লিষ্ট হওয়ার দাবি রাখে। 
লেখক: উন্নয়নকর্মী, কথাশিল্পী 
[email protected]

 

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status