ঢাকা, ৪ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

ভয়াল সেই ২১শে আগস্ট

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
২১ আগস্ট ২০২৩, সোমবারmzamin

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের কাল রাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের হত্যা করার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায় রচিত হয়েছিল এদিনে। দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট। ২০০৪ সালের সারা দেশে জঙ্গিদের বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২১শে আগস্ট বিকালে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছালে, একটি ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চে বক্তৃতা শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করার ঘোষণা দিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে আসতে থাকেন। ঠিক এমন সময় শুরু হয় মঞ্চ লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরও ১২ জন নিহত হন। পৈশাচিক সেই হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী বেগম আইভি রহমান নিহত হন। শুধু গ্রেনেড হামলাই নয়, সেদিন তাদের প্রধান টার্গেটে থাকা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার গাড়ি লক্ষ্য করেও চালানো হয় ৬ রাউন্ড গুলি। শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও আহত হন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার শ্রবণশক্তি।

২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের পেছনে ছিল প্রভাবশালী রাজনৈতিক, দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা, কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গি এবং পাকিস্তান।

বিজ্ঞাপন
পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের মতোই ২১শে আগস্টের হামলার নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। যার মাস্টার মাইন্ড ছিলেন ওই সময়ের কিছু সামরিক কর্মকর্তা এবং হাওয়া ভবনে বসে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। হামলায় অংশ নেয়া ব্যক্তিদের পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরে তাদের গ্রেনেড সরবরাহও করে দেয় পাকিস্তান। হামলা শেষে পাকিস্তান ঘাতকদের আশ্রয়ও দেয়। মূলত আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।

ওই ঘটনায় হত্যা, হত্যাচেষ্টা, ষড়যন্ত্র, ঘটনায় সহায়তাসহ বিভিন্ন অভিযোগে একটি মামলা হয়। যাতে আসামী সংখ্যা ছিল ৫২ জন। একই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রবাদি আইনে অপর একটি মামলায় আসামি সংখ্যা ৩৮ জন। ভয়াবহ সেই ঘটনায় ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ই অক্টোবরে এই মামলায় রায় ঘোষিত হয়। রায়ে বিএনপি  নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর  এবং আব্দুস সালাম পিন্টু সহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয় ঢাকার একটি বিশেষ দ্রুত আদালত। রায়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস  চেয়ারম্যান ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরী সহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। এ ছাড়া অন্য মামলায় ফাঁসির কারণে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সী, শরীফ শাহেদুল আলম বিপুলকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

এই বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় যারা নিহত হন তাদের মধ্যে ছিলেন আইভি রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, আমিনুল আসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন এবং ইসাহাক মিয়া প্রমুখ।

আহত হয়েছিলেন বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, সাহারা খাতুন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা আখতার, উম্মে রাজিয়া কাজল, নাসিমা ফেরদৌস, শাহিদা তারেক দীপ্তি, রাশেদা আকতার রুমা, হামিদা খানম মনি, ইঞ্জিনিয়ার সেলিম, রুমা ইসলাম, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন, মামুন মল্লিক প্রমুখ।
২১শে আগস্টের হামলা রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত ঘটনা। রাজনীতি ভয়াবহভাবে দুর্বৃত্তায়িত হলেই এটি সম্ভব। এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ন্যায়বিচারে পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদেরও সজাগ হওয়ার প্রয়োজন। আইনগত ব্যবস্থা ছাড়াও দলের ভেতর থেকে প্রতিহিংসার উপাদান দূর করতে হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই রাজনীতি থেকে দূর করতে হবে অপশক্তি ও অপচিন্তা।

১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সবাইকে হত্যাকারীরা তখন দেশে না থাকা বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনাকে হত্যা করতে চেয়েও পারেনি। তাই তখনকার খুনি চক্রের উত্তরসূরীরা ২০০৪-এ একুশে আগস্টে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের চক্রান্ত করে। এই ঘৃণ্য হত্যাকারীদের অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বিধান করে ভবিষ্যতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হবে। 

সমপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মদতে ও পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের ন্যক্কারজনক ঘটনা। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রবিরোধী জঙ্গিবাদী মানসিকতার এবং হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাসী যে শক্তিটি তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল তারা জাতির কাছে ক্ষমা পেতে পারে না। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এদেশের সকল মানুষের কাছে এটি এক বিস্ময়কর বেদনার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

পাঠকের মতামত

চিন্তার কিছু খোরাক দিচ্ছি, ঠিক ঐ মূহূর্তেই গ্রেনেড হামলে পড়ে (হাসিনা হত্যার উদ্দেশ্যে), তার আগেও নয়, পরেও নয় / সে সময় বিদেশীরা আসলে চাইছিল বিরোধী দলের নেত্রী হাসিনার গাড়ীটি চেক করতে, কিন্তু ওটি করতে দেয়া হয়নি, কারণটি কি? মুক্তাঙ্গন থেকে কেন হঠাৎ মিটিংএর স্থান পরিবর্তন? আইভি রহমানকে রাস্তা ছেড়ে ট্রাকে উঠতে বার বার হাসিনার আহবান, ট্রাক রেখে হামলাটি হবে তার কি আগাম জানা ছিল? অস্ত্র থেকে বের হওয়ার গুলির কোনো ব্যালাস্টিক বা ফরেনসিক কোনো টেষ্টই করা হয়নি, কেন করতে দেয়নি আওয়ামীলীগ? ডেইলি স্টার খবর ছাপে, “বুলেট প্রুফ মার্সিডিজের কাঁচ ভেঙ্গে ভিতরে গুলি ঢুকেছে“ কিন্তু মার্সিডিজ কোম্পানির নজরে আসলে তারা তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং পরীক্ষার জন্য গাড়িটি ফেরত চায়। তখন হাসিনা লিখিতভাবে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তীতে ব্যালাস্টিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় নাটক ধরা পড়ার ভয়ে গাড়িটিকে ধংস করে ফেলার কথা দাবী করে আ’লীগ। তারেক রহমানকে জড়িয়ে দেয়া মুফতি হান্নানের জবানবন্দি পুরোটাই ছিল পুলিশের শিখিয়ে দেয়া – সাজানো।

Nazma Mustafa
২১ আগস্ট ২০২৩, সোমবার, ২:৪৯ অপরাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2023
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status