শেষের পাতা
কক্সবাজারকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে দুই মেগা প্রকল্প
কাজী সোহাগ, কক্সবাজার থেকে
২৭ জুলাই ২০২৩, বৃহস্পতিবারপর্যটন নগরী হিসেবে দেশে-বিদেশে সুপরিচিত কক্সবাজারকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে সরকারের দুই মেগা প্রকল্প। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আমদানি করা জ্বালানি তেল জাহাজ থেকে সহজে, নিরাপদ, স্বল্প খরচে, স্বল্প সময়ের মধ্যে খালাস করার জন্য গভীর সমুদ্রে ডাবল পাইপলাইনের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্প। অপরটি প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন’ প্রকল্প। সরজমিন এই দুই প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে উন্নয়নের নানা চিত্র। এসপিএম প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৮৬.৫৮ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি প্রায় ৯৭ শতাংশ। প্রকল্পটি চালু হলে ১১ দিনে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল খালাস করা যায়, সেটির সময় কমে আসবে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায়। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর লাইটার জাহাজের প্রয়োজন হবে না। এতে পরিবহন খরচ ও অপচয় হ্রাস পেয়ে সরকারের বাৎসরিক বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের পরিচালক। প্রকল্পের তথ্যমতে, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের চাহিদা পূরণ এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল ও ফিনিশড প্রডাক্ট স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে এবং নিরাপদে খালাস করার জন্য এসপিএম প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে জি-টু-জি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এদিকে শত বছরের কুতুবদিয়ার মানুষের জীবনযাত্রার মান সমৃদ্ধ হলেও, বিদ্যুৎ না থাকায় সামগ্রিক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত ছিল। স্বাধীনতার ৫ দশক পেরিয়ে গেলেও এখানকার মানুষের কথা ভাবেনি কোনো সরকার। কিন্তু এখানকার মানুষের জীবনমান বদলে গেছে। সর্বক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করে ওঠা কুতুবদিয়ার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়িসহ বাজার। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ আসবে এটা অকল্পনীয় ছিল। কুতুবদিয়ার মানুষের স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক ছিলেন। ১২ই এপ্রিল রাত থেকে আমরা বিদ্যুৎ পেয়েছি। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়ে চট্টগ্রাম শহরের মতো এখানে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। মাত্র দুই মাস আগে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে কুতুবদিয়ায় জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর পর এমন চিত্র ফুটে উঠে।
ফলে ওই এলাকার আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বলেও জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। দেশব্যাপী শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে ২০২০ সালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন’ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।
মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে স্বাভাবিক লাইন নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো সুযোগ না থাকায় সাবমেরিন ক্যাবল ব্যবহার করা হয়েছে। এটি ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছিল। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি থেকে মগনামা ঘাট পর্যন্ত ৩৩ কেভি রিভার ক্রসিংসহ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে সাগরের তলদেশে ফাইবার অপটিকসহ ৫ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সাবমেরিন লাইন নির্মাণের মাধ্যমে কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ দিতে কুতুবদিয়ায় নির্মিত হয়েছে দুই কিলোমিটার বিতরণ লাইন। দ্বীপটির প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বর্তমানে প্রায় ২ লাখ মানুষ বসবাস করেন। এখানে ১৯৮০ সালে জেনারেটরের মাধ্যমে প্রায় ৬০০ গ্রাহকের মধ্যে সান্ধ্যকালীন কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ভাঙায় সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় স্বল্প আকারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পিডিবি।
দ্বীপটির বাসিন্দারা জানান, দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না। ফলে এতদিন এই দ্বীপে সিজার অপারেশন চালু হয়নি। ফলে বাধ্য হয়েই সন্তানসম্ভবা মায়েদের নিয়ে ছুটতে হতো কক্সবাজার সদর কিংবা চকরিয়ায়। বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ থেকে দেশের মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ট্রলার। সাগরের উত্তাল ঢেউ উপেক্ষা করেই সন্তানসম্ভবা মায়েদের নিয়ে যাওয়া হতো। কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, গত এপ্রিল মাসে দ্বীপটিতে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। এরপর থেকে এখন সিজার অপারেশনের জন্য তাদেরকে আর কক্সবাজার কিংবা চকরিয়ায় যেতে হয় না। এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই কম খরচে সিজার করাতে পারছেন দ্বীপটির বাসিন্দারা। চলতি বছরের শুরু থেকে সিজার অপারেশনের পরিকল্পনা হাতে নেয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এরমধ্যে গত তিন মাসে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৯টি সিজার অপারেশন করা হয়েছে।