শেষের পাতা
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন
শিবালয়ে গুলি ককটেল ও মারধরে উত্তপ্ত ভোটের মাঠ
রিপন আনসারী, মানিকগঞ্জ থেকে
১৫ মে ২০২৪, বুধবারনির্বাচনের আগেই টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায়। প্রভাবশালী দুই প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষের লোকজন ভোটের মাঠ ক্রমেই উত্তপ্ত করে তুলেছে বলে অভিযোগ ভোটারদের। প্রশাসনও তাদের প্রভাবের কাছে অনেকটাই অসহায়। দুই প্রার্থী তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভোটের মাঠে পেশিশক্তি বলয় তৈরি করছে। ইতিমধ্যে প্রভাবশালী এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর ছেলে প্রতিপক্ষের কর্মী-সমর্থকদের ওপর চড়াও হয়ে ফাঁকা গুলি করেছে। এ ঘটনায় তোলপাড় চলছে।
কয়েকদিনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কখনো ককটেল নিক্ষেপ, কখনো মারধর আবার কখনো ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এসব ঘটনার পরপরই দুইপক্ষ পাল্টাপাল্টি প্রতিবাদে রাজপথ সরগরম করে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করেছে। আগামী ২১শে মে দ্বিতীয় ধাপে হবে শিবালয় উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। চেয়ারম্যান পদে এখানে তিন ভিআইপি প্রার্থীর দু’জনই ভোটের মাঠে আক্রমণাত্মক। একজন হলেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও শিবালয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউর রহমান খান জানু। অপরজন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুর রহিম খান। প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক প্রার্থী পান্নু খানের বিরুদ্ধে এখনো ভোটের মাঠে বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া যায়নি।
ভোটের মাঠে প্রভাব বিস্তার নিয়ে প্রশাসন উভয় পক্ষকে হুঁশিয়ারি করলেও তারা তোয়াক্কা করছেন না। প্রভাবশালী ওই দু’জনের গণ্ডগোলের একাধিক লিখিত অভিযোগ থানায় আছে। পাল্টাপাল্টি মামলাও হয়েছে। শুক্রবার বিকালে আরিচা ঘাট সংলগ্ন ডাক্তার বাড়ি এলাকায় পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউর রহমান জানু এবং জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুর রহিম খানের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মারামারি হয়। এ সময় রেজাউর রহমান জানুর ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ সম্পাদক ফাহিম খান পিস্তল উঁচিয়ে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। ঘটনার পরপরই চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুর রহিম খানের পক্ষের কর্মী-সমর্থকরা রাজপথ দখল করে প্রায় ৩ ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ করে প্রতিবাদ জানায়। মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ গোলাম আজাদ খান ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন। ফাঁকা গুলি ছোড়ার সত্যতা স্বীকার করে ফাহিম গণমাধ্যমকে জানান, রহিম খানের কর্মীরা তার ওপর হামলা করায় আত্মরক্ষায় তিনি নিজের বৈধ পিস্তল দিয়ে একটি ফাঁকা গুলি করেন।
এর আগে ২৭শে এপ্রিল রাতে নির্বাচনী প্রচারণা শেষে ফেরার পথে রহিম খানের গাড়িকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। ওই ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগে রহিম খান জানান, উপজেলার বিরিরাস্তি এলাকায় তার গাড়িতে ককটেল নিক্ষেপ ও ফাঁকা গুলি করা হয়। এই ঘটনাতেও রেজাউর রহমান জানুর ছেলে ফাহিমসহ তার কর্মীদের দায়ী করেন রহিম খান। ঘটনার তিন দিন পর ৩০শে এপ্রিল শিবালয় উপজেলার ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের টেপরা বাসস্ট্যান্ডে রহিম খানের কর্মী-সমর্থকরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে প্রতিবাদ জানান।
ভোটাররা জানিয়েছেন, রেজাউর রহমান জানু এবং আব্দুর রহিম খান ভোটের মাঠ ক্রমেই উত্তপ্ত করে তোলায় আতঙ্কিত সাধারণ ভোটাররা। আব্দুর রহিম খান সাংবাদিকদের বলেন, আমি ভোটের মাঠে নিরাপদ নই। ভোট সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। আমার প্রতিপক্ষ একের পর এক সংঘাত তৈরি করে যাচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণা করতে গিয়ে তার গাড়িতে ককটেল নিক্ষেপ এবং ফাঁকা গুলির ঘটনা ঘটিয়েছে রেজাউর রহমান জানুর লোকজন। তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়া অন্য কারও কাছে বৈধ আগ্নেয়ান্ত্র থাকার কথা নয়। কিন্তু আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ছেলের কাছে কীভাবে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে, প্রশাসন তা দেখে না! পক্ষান্তরে আরেক প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান রেজাউর রহমান খান জানু বলেছেন, শিবলায় উপজেলার শান্ত ভোটের মাঠ তার প্রতিপক্ষ রহিম খান ও তার কর্মী-সমর্থকরা অশান্ত করে তুলেছে। আমার কর্মী- সমর্থকদের অযথা মারধর এবং হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া মিথ্যা মামলা দায়ের করে পরিবেশ নষ্ট করছে।
তার ছেলের ফাঁকা গুলির বিষয়ে জানু বলেছেন, আমার জান-মালের ?ওপর কেউ আক্রমণ করলে আমার মৃত্যু হয়ে যেতে পারে। এরকম পরিস্থিতি যদি ঘটে তাহলে আমি বৈধ ব্যবস্থা নিতে পারবো। শিবালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রউফ সরকার বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো মোটামুটি ভালো আছে। সামনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে কোনো ধরনের অবনতি না হয় এদিকে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। গুলি এবং মারধরের ঘটনায় রহিম খান এবং রেজাউর রহমান জানুর পক্ষে-বিপক্ষে দুটি মামলা হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে শিবালয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, একের পর এক দুই প্রার্থীর সংঘাতে রাজনৈতিকভাবে আমরা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। নির্বাচনের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি অনেক কমে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
রেজাউর রহমান জানু এবং রহিম খানের পেছনের রাজনীতি:
রেজাউর রহমান খান জানু: একাধারে বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার। এক সময় জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কার্যত ২০০০ সালের পর আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। পরপর দুইবার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন। মাঝে দেশে জরুরি অবস্থার সময় অঘোষিতভাবে আওয়ামী লীগ ছেড়ে ফেরদৌস আহমেদ কোরাইশীর রাজনৈতিক দলে অন্তর্ভুক্ত হন। পরে সুবিধা করতে না পেরে আবারো আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।
আব্দুর রহিম খান: জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সহ-সভাপতি। এর আগে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে তিনি ছিলেন জাকের পার্টির মানিকগঞ্জ জেলা কমিটির দীর্ঘদিনের সভাপতি। পরে জাকের পার্টি ত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।