শেষের পাতা
হাঙ্গার প্রজেক্টে ড. বদিউল আলম মজুমদারের তিন দশক
স্টাফ রিপোর্টার
৩১ মে ২০২৩, বুধবার
ড. বদিউল আলম মজুমদার। গণতন্ত্র, নির্বাচন, উন্নয়ন ও সুশাসন নিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম সরব কণ্ঠস্বর। বিগত ৩০ বছর ধরে তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়াও তিনি এই সংস্থার গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। স্বনামধন্য নাগরিক সংগঠন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তিনি। টানা ৩০ বছর হাঙ্গার প্রজেক্টে নেতৃত্ব দিয়ে আসা ড. বদিউল আলম মজুমদারকে সম্মাননা দিচ্ছেন তার সহকর্মীরা। হাঙ্গার প্রজেক্টে ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তার সহকর্মী ও স্বেচ্ছাব্রতীদের পক্ষ থেকে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টায় ওয়াইডাব্লিওসিএ অব বাংলাদেশ’র অডিটোরিয়ামে (ইকবাল রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা) এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে অতিথি হিসেবে বিচারপতি এমএ মতিন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, শিক্ষাবিদ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, নিজেরা করি-এর নির্বাহী পরিচালক খুশী কবিরসহ সুধীজনরা উপস্থিত থাকবেন।
১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার পোলাইয়া গ্রামের রঙ্গু মিয়া মজুমদার ও আঙ্গুমেন নেসার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের বহু প্রতীক্ষিত একমাত্র সন্তান। পারিবারিক আর্থিক দুরবস্থার ফলে মাধ্যমিকের গণ্ডি শেষ না করেই তার বাবা নওয়াব ফয়জুন্নেছা জমিদারি এস্টেটে নায়েবের চাকরি নেন। পরে কিছুকাল সরকারি চাকরি করেন এবং রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। পরবর্তীতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়েন। পরিবারে অন্য কোনো উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকায় শিশুকাল থেকেই চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে উঠেন বদিউল আলম মজুমদার। বাবা হাফেজিয়া মাদ্রাসায় পড়াতে চাইলেও মায়ের অনমনীয়তায় ১৯৫৩ সালে উত্তরদা জুনিয়র হাইস্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন বদিউল আলম মজুমদার। শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন। পারিবারিকভাবে আর্থিক সংকটের কারণে লেখাপড়ার পাশাপাশি তাকে ক্ষেত-খামারে কৃষিকাজ করতে হয়েছে। লাকসাম হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন ’৬২-শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন বদিউল আলম মজুমদার। নবাব ফয়জুন্নেছা কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়াবস্থায় তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে নির্বাচিত হন।
১৯৬৪ সালে এইচএসসি পাসের পর মাত্র ৪ আনা পয়সা পকেটে নিয়ে বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা শহরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে ভর্তি হন। তিনি ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেন। ইন্টারমিডিয়েটে ভালো ফলের জন্য পাওয়া বৃত্তির টাকা থেকে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালানোর পাশাপাশি হলের বয়-বাবুর্চিদের জন্য প্রতিষ্ঠিত নাইট স্কুলে পড়িয়ে বিনামূল্যে হল ডাইনিংয়ে খাওয়ার সুযোগ লাভ করেন বদিউল আলম মজুমদার। মায়ের ভরণপোষণের জন্য টিউশনিও করতে থাকেন তিনি।
স্কুলজীবন থেকেই বদিউল আলম মজুমদার ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি একাধিকবার মোনায়েম খানের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত এনএসএফ’র আক্রমণের শিকার হন। ৬ দফা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বদিউল আলম মজুমদার ১৯৬৬ সালে ইকবাল হল ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সময়ে প্রতিটি হলের একজন করে ছাত্র নিয়ে গঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে সরকারিভাবে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। ১৯৬৭ সালে বদিউল আলম মজুমদার ইকবাল হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন।
অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে ১৯৬৮ সালে মাস্টার্স পরীক্ষার আগেই তিনি ঢাকার তদানীন্তন কায়েদে আজম কলেজের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী কলেজ) প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে ছাত্রজীবন শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে রোটারি ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যান। এরপর তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার ক্ল্যারমন্ট গ্রাজুয়েট স্কুল থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন এবং কেইস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটি থেকে মাত্র ৩১ বছর বয়সে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ডে শুভানুধ্যায়ীদের সহায়তায় তিনি ‘বেঙ্গল রিলিফ গ্রুপ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
পিএইচডি অর্জনের পর ড. বদিউল আলম মজুমদার ১৯৭৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল ইউনিভার্সিটি ও ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন এবং অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। মাঝখানে ১৯৮০ সালে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে’র (নাসা) ‘স্পেস ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন প্রজেক্ট’ প্রণয়নে সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ করেন। এ প্রকল্পের মাধ্যমে মহাকাশের দূষণমুক্ত পরিবেশে স্বল্প ওজনের ও বেশি মূল্যের ওষুধ, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গবেষণা কর্মের সূচনা হয়। এ সময় নাসার মহাকাশ গবেষণার কাজে নিবিষ্ট থাকার নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্তে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সিয়াটল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালীন তিনি কিছু সময় সৌদি রাজপরিবারের অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করেন।
বাংলাদেশের প্রতি দায়বদ্ধতার ঋণ শোধ করতে ১৯৯১ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং প্রায় ২ বছর দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ান। এ সময় ইউএসএআইডি’র একটি প্রকল্পের প্রধান হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেন।
১৯৯৩ সালের এপ্রিলে ড. বদিউল আলম মজুমদার দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’র সঙ্গে যুক্ত হন। তখন থেকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্তির প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত, ক্ষমতায়িত এবং কমিউনিটিকে সংগঠিত করে আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে একটি ব্যতিক্রমী উন্নয়ন ধারা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দি হাঙ্গার প্রজেক্টের বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত উন্নয়ন ধারার মাধ্যমে তিনি স্বেচ্ছাব্রতী কার্যক্রমের ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনেন। তার উদ্যোগ ও অনুপ্রেরণায় দি হাঙ্গার প্রজেক্ট ‘উজ্জীবক প্রশিক্ষণ’ প্রবর্তন করে। এর মাধ্যমে দেশব্যাপী অসংখ্য মানুষের গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে এবং তারা নতুন উদ্দীপনায় নিজের ও সমাজের মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে নিয়োজিত হন। দেশের তরুণদের সম্ভাবনার বিকাশে ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্যে তার অনুপ্রেরণা ও উদ্যোগে ‘ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গার’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে বর্তমানে ১ লাখেরও বেশি স্বেচ্ছাব্রতী তরুণ- তরুণী কাজ করছেন। একইসঙ্গে বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠার কাজেও নিয়োজিত রয়েছেন ড. বদিউল আলম মজুমদার।
প্রয়াত অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ ও বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে ২০০২ সালে ‘সিটিজেন্স ফর ফেয়ার ইলেকশন্স’ নামে একটি নাগরিক সংগঠন গঠিত হয় এবং তিনি এর সদস্য সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৩ সালে সংগঠনটি নাম পরিবর্তন করে ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’ নাম ধারণ করে।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বিভিন্ন এডভোকেসি ও আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কন্যাশিশুদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাওয়া জাতীয় কন্যাশিশু এডভোকেসি ফোরামের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং সভাপতি হিসেবে এখনো দায়িত্ব পালন করছেন। তার প্রস্তাব এবং দি হাঙ্গার প্রজেক্টের কর্মসূচি ও আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশ সরকার ৩০শে সেপ্টেম্বরকে ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে জাতিসংঘ ১১ই অক্টেবরকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অব দ্য গার্ল চাইল্ড’ ঘোষণা করে।
পারিবারিক জীবনে তিনি ২ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক। বড় ছেলে ড. মাহবুব মজুমদার বাংলাদেশ ‘ম্যাথ অলিম্পিয়াড’ টিমের অবৈতনিক কোচ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাটা সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট ছেলে ডা. মাহফুজ মজুমদার যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। বড় মেয়ে শাহিরা মজুমদার একজন লেখক। তিনি বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণে কাজ করছেন। মেজো মেয়ে সাবিরা রোজানা মজুমদার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত এবং ছোট মেয়ে সামিরা মজুমদার একজন গবেষক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।