ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

সময় অসময়

ঈদে এত নাটক, এত সিনেমা আর বিনোদন অনুষ্ঠান ছেড়ে কোথাও যাবেন না প্লিজ...

রেজানুর রহমান
২১ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার
mzamin

অনেকেই ভাবতেন এটি জাদুর বাক্স। তা না হলে মানুষ কীভাবে টেলিভিশনের বাক্সে আসে আর যায়? কাঁদে, হাসে? যদিও সেই জাদুর বাক্সটি এখন অনেকটাই গুরুত্বহীন। পারিবারিক ভাবে দলবেঁধে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখার সেই অতীত ঐতিহ্য এখন অনেকটাই ম্লান। এখন সবার হাতেই টেলিভিশন চ্যানেল। মোবাইল ফোনে শুধু বিভিন্ন টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নয় গোটা দুনিয়ার খবরাখবর, আনন্দ-বিনোদন, নাটক-সিনেমা সবই দেখা যায়। ফলে একসময়ের আদরের টেলিভিশন সেটটির প্রতি অনেকে ফিরেও তাকান না। অথচ একটা সময়ে এই টেলিভিশন সেটটিই পরিবারের সকলের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণই না ছিল। যুগ বদলেছে। যৌথ পরিবার ভেঙে যাবার ফলে জাদুর বাক্সটি অনেকাংশে গুরুত্ব হারিয়েছে। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ায় অনেক পরিবর্তনের মুখোমুখি আমরা।

বিজ্ঞাপন
পরিবর্তনগুলো আপাতদৃষ্টিতে স্বস্তির হলেও পারিবারিক বন্ধনের ক্ষেত্রে একটা সময়ে সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে আমার বিশ্বাস

 

টেলিভিশনে আপনি কি দেখবেন, কি দেখবেন না, দেশের টেলিভিশন দেখবেন নাকি বিদেশের টেলিভিশন দেখবেন? পত্রিকা পড়বেন কি পড়বেন না? এটি সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। একটা সময় ছিল যখন কাউকে বলে দিতে হতো না যে, এবারের ঈদে বিটিভি’র সঙ্গেই থাকুন। বিটিভিই ছিল বাংলাদেশের একমাত্র টিভি চ্যানেল। তখনকার দিনে দেশ-বিদেশের এত স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ছিল না। কাজেই বিটিভি’র প্রতিই দেশের মানুষের আস্থা, বিশ্বাস প্রকট ছিল। বিশেষ করে ঈদের সময় আনন্দ-বিনোদনের একমাত্র অনুষঙ্গ ছিল বিটিভি’র নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান। এমনও হয়েছে বিটিভি’র ঈদ অনুষ্ঠান দেখার জন্য অনেকে আগে ভাগে সাংসারিক কর্মকাণ্ড সেরে ফেলতেন। তারপর পরিবারের সবাইকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসতেন। একটা টেলিভিশন সেট ছিল অনেক প্রিয়, আদরের এবং অবশ্যই সংসারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যার বাসা-বাড়িতে টেলিভিশন সেট ছিল তাকে বা তাদেরকে সমীহের চোখে দেখা হতো। কারও বাসায় নতুন টেলিভিশন সেট এসেছে এই খবর মুহূর্তেই ‘রাষ্ট্র’ হয়ে যেত। নতুন টেলিভিশন সেট দেখার জন্য পাড়া-প্রতিবেশীরা ভিড় করতেন। এমন ঘটনাও ঘটতো, গ্রামের অবস্থাপন্ন কারও বাড়িতে টেলিভিশন সেট কিনে আনা হয়েছে। রাতে বাড়ির উঠোনে টেলিভিশন সেটটি বসানো হতো। গ্রামের মানুষ অর্থাৎ পাড়া-প্রতিবেশীরা দলবেঁধে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখতে আসতেন। অবাক বিস্ময়ে অনেকে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখার পাশাপাশি টেলিভিশন সেটটাকে দেখতেন। অনেকেই ভাবতেন এটি জাদুর বাক্স। তা না হলে মানুষ কীভাবে টেলিভিশনের বাক্সে আসে আর যায়? কাঁদে, হাসে? যদিও সেই জাদুর বাক্সটি এখন অনেকটাই গুরুত্বহীন। পারিবারিক ভাবে দলবেঁধে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখার সেই অতীত ঐতিহ্য এখন অনেকটাই ম্লান। এখন সবার হাতেই টেলিভিশন চ্যানেল। মোবাইল ফোনে শুধু বিভিন্ন টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নয় গোটা দুনিয়ার খবরাখবর, আনন্দ-বিনোদন, নাটক-সিনেমা সবই দেখা যায়। ফলে একসময়ের আদরের টেলিভিশন সেটটির প্রতি অনেকে ফিরেও তাকান না। অথচ একটা সময়ে এই টেলিভিশন সেটটিই পরিবারের সকলের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণই না ছিল। যুগ বদলেছে। যৌথ পরিবার ভেঙে যাবার ফলে জাদুর বাক্সটি অনেকাংশে গুরুত্ব হারিয়েছে। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ায় অনেক পরিবর্তনের মুখোমুখি আমরা। পরিবর্তনগুলো আপাতদৃষ্টিতে স্বস্তির হলেও পারিবারিক বন্ধনের ক্ষেত্রে একটা সময়ে সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে আমার বিশ্বাস। 

 

 


একটি পুরনো টেলিভিশন সেটের কথাই যদি ধরি। একথা সত্য, একটা সময় প্রতিটি পরিবারে এই টেলিভিশন সেটটিই পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতো। টেলিভিশনের বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান দেখার জন্য পরিবারের যে যেখানেই থাকেন না কেন নির্ধারিত সময়েই হাজির হতেন। এর ফলে পরস্পরের মধ্যে পারিবারিক নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি হতো। একটা পারিবারিক আড্ডা বসতো। অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে কতো কথা, কতো স্মৃতি, প্রয়োজনের কথাও গুরুত্ব পেতো। পারিবারিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নেয়া হতো টিভি রুমে বসে। সেই টিভি রুম এখন বলতে গেলে নীরবতায় সময় কাটায়। মোবাইল ফোনে এখন টেলিভিশন অনুষ্ঠানও দেখা যায়। কাজেই ড্রয়িং রুমে বসে টিভিতে অনুষ্ঠান দেখার সময় কোথায়?
ধরে নিলাম এটা একটা পরিবর্তন। শুয়ে, বসে, পথে যেতে যেতে মোবাইল ফোনে অনুষ্ঠান দেখার অবারিত সুযোগ থাকায় টেলিভিশন সেট হয়তো গুরুত্ব হারিয়েছে। কিন্তু দেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠান গুরুত্ব হারানোর কারণ কি? এক বিটিভি থেকে দেশেই এখন ৩০টিরও বেশি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল কার্যকর। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য দেশে এত টেলিভিশন চ্যানেল থাকার পরও দেশের একশ্রেণির দর্শক পাশের দেশের টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতি অতিমাত্রায় আগ্রহী। অনেকে প্রায়শই বলেন, এই দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে যা দেখানো হয় তা দর্শক ধরে রাখার মতো নয়। তাদের কথার মর্মার্থ, দেশের মানুষ দেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠান খেতে পছন্দ করে না। অনেকে হয়তো বলবেন টেলিভিশন অনুষ্ঠান কি খাওয়ার মতো কোনো জিনিস? সহজ উত্তরÑ দেখাকে খাওয়া হিসেবেই বলতে অভ্যস্ত অনেকে। এই যে অনেকে বলেন, আমাদের ভালো নাটক হয় না, ভালো সিনেমা হয় না। সাহিত্যের কোনো ভালো খবর নাই। তারা ভুল বলেন। বেশ কিছুদিন আগে সিনেমা দেখা না দেখা নিয়ে একটি ছোট্ট জরিপ করেছিলাম। ৫০ জনের কাছে প্রশ্ন ছিলÑ আপনি কি দেশের সিনেমা দেখেন? ৪৮ জন উত্তর দিয়েছেন, দেশের সিনেমা দেখেন না। অথচ তারা নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছেন এই দেশে সিনেমা দেখবেন কোন ভরসায়। ভালো সিনেমা কোথায়? ভেবে দেখুন কতোটা স্ববিরোধী বক্তব্য? আপনি দেশের সিনেমা দেখেনই না অথচ জোর গলায় বলছেন, এই দেশে ভালো সিনেমা হয় না। না দেখে কী করে ভালো-মন্দ মন্তব্য করেন? 
প্রতিবছর ঈদে আমাদের দেশে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ নাটক, টেলিফিল্ম, ঈদ ধারাবাহিক, একাধিক নতুন সিনেমা ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচার হয়। তবুও দেশের অনেক দর্শক ঈদের দিনেও ভিন দেশের টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখেন। আবার তারাই বলেন, টিভি অনুষ্ঠান ভালো হয় না। এবার সবার প্রতি একটা নিবেদন রাখতে চাই। এই ঈদে প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেল ৩ দিন, ৫ দিন, ৭ দিনের ঈদ অনুষ্ঠানমালা সাজিয়েছে। আড়াইশ’রও বেশি নতুন টিভি নাটক ও টেলিফিল্ম প্রচার হবে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে। বিটিভিসহ একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলে ঈদ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচার হবে। এ ছাড়া প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল একাধিক নতুন, পুরাতন সিনেমা প্রচার করবে। ঈদের এত আয়োজন থাকা সত্ত্বে¡ও আমাদের কি উচিত হবে ঈদ উৎসবেও অন্যদেশের টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতি আগ্রহ দেখানো? গত বছর ঈদুল ফিতরের দিন পরিচিত ২০ জন আত্মীয়ের বাসায় ফোন করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম- আজ কোন টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখছেন? দেশের না বিদেশের? ১৪ জন দেশের টিভি অনুষ্ঠান দেখছেন। ৬ জন ঈদের দিনেও বিদেশি টিভি চ্যানেলের প্রতিই আগ্রহী ছিলেন। ২০ জনে ৬ জন। সংখ্যাটি হয়তো বড় নয়? কিন্তু ১০০ জনে কতোজন দাঁড়ায় ভাবুন একবার। হাজারে কতোজন? 
আবারো বলি টেলিভিশন দেখা না দেখা, পত্রিকা পড়া, না পড়া, গান শোনা না শোনা সবই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবুও কথা থেকে যায়। দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো, নির্মাতারা, প্রিয় অভিনয় শিল্পীরা অনেক কষ্ট করে এবারও ঈদের নাটক, টেলিফিল্ম সহ অন্যান্য অনুষ্ঠান বানিয়েছেন। সবকিছুই দর্শকদের জন্য। কাজেই দর্শক হিসেবে আমাদেরও কিছু দায়-দায়িত্ব আছে। যতটা পারি এবার ঈদে নাটক, সিনেমা সহ অন্যান্য অনুষ্ঠান দেখার ক্ষেত্রে দেশকেই গুরুত্বে রাখবো- এই আন্তরিক ভাবনাটাই জরুরি। 
ঈদে দেশের প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকা ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। যেকোনো পত্রিকার ঈদ সংখ্যা ঈদ উপহার হিসেবে মন্দ নয়। প্রিয়জনকে ঈদ উপহার হিসেবে ঈদ সংখ্যা দিতে পারেন। 
শেষ অনুরোধ, ঈদে আপনার টিভি রুমের আড্ডাটা সচল করুন। সবাই মিলে দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের ঈদ অনুষ্ঠান উপভোগ করুন। একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি- আপনি আশাহত হবেন না। আমাদের নাটক, সিনেমা, সাহিত্যের উজ্জ্বল পরিবর্তন আপনাকে সাহসী করে তুলবে। 
ও হ্যাঁ, ঈদে সাধ্যমতো দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। প্রতিবেশীর খবর রাখবেন। অনেক শুভ কামনা সবার জন্য। ঈদ মোবারক। 
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।  

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status