মত-মতান্তর
রম্য
বড় জেলা নিয়ে ছোট পাঁচালী
গাজী মিজানুর রহমান
(৫ মাস আগে) ১০ এপ্রিল ২০২৩, সোমবার, ৪:০০ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১:১৬ অপরাহ্ন

ফেসবুকে ইদানীং দেখি, একটা চটুল কথা: কোন জেলার ছেলে ভালো, কোন জেলার মেয়ে ভালো, বলতে পারেন? একসময় শুনতাম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, কুমিল্লার রসমালাই, যশোরের খেঁজুরের গুড়, বগুড়ার দই ভালো। এখন আর তেমন শুনিনা। কারণ দুটো হতে পারে -- এক, আসল ভালো
আর ভালো নেই। দুই, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে ভালো জাতের নমুনা জেলার চৌহদ্দি ছেড়ে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। তবে ওই যে 'ডিএনএ' নামটা মনে পড়লে ভাবি, কোন জেলার ছেলে বা কোন জেলার মেয়ে ভালো – এ কথার কিছু ভিত্তি আছে।
জেলার ডিএনএ বিশ্লেষণ করে জেলাভিত্তিক সাংস্কৃতিক চরিত্র খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। ১৯ টি জেলা থাকার আমলে আমাদের দেশে যেসব জেলা ছিল, অর্থাৎ এখন আমরা যাকে বৃহত্তর জেলা বলি, সেই জেলা কাঠামো ১৭৮৬ সাল থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত কার্যকর ছিল। দীর্ঘকাল এক আদালতে বিচার-আচার, এক রাজস্ব ব্যবস্থায় খাজনাপাতি, এক বড় বাণিজ্য-কেন্দ্রে সওদাপাতি হতে হতে, আর পরস্পরের ঘরের কথা জানতে জানতে, মানুষের মধ্যে এক ধরনের নীরব সাংস্কৃতিক ডিএনএ তৈরি হয়ে যায়। এর মধ্য থেকে একটা ভালো কমন দিক, আবার একটা মন্দ কমন দিক উঠে আসে। এটা কিন্তু অবান্তর নয়। উদাহরণগুলো মনে মনে মিলিয়ে দেখতে পারেন। আঞ্চলিক ভাষার কথাই ধরা যাক, এটা বৃহত্তর জেলাকে কেন্দ্র করে আলাদা আলাদা দৃষ্টিগ্রাহ্য পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। বিয়েসাদির অনুষ্ঠানের চরিত্র , খানাখাদ্য গ্রহণের সময় কোনটা দিয়ে শুরু -- কোনটা দিয়ে শেষ , ঈদ-পার্বনে কুটুম-বাড়ি যেতে হলে হাতে করে কী কী নিয়ে যেতে হবে, মিষ্টি কি হাড়িতে থাকবে –নাকি প্যাকেটজাত হয়ে ঝুড়িতে, দই কি মিষ্টি দই হবে – নাকি খাওয়ার সময় চিনি মিশিয়ে খেতে হবে, এসব বিষয়ে ডিএনএ ভিন্ন ভিন্ন।
তবে জেলার ভালোমন্দ বিষয়ে নিজের মনের কথা গোপনে রেখে ফেসবুকে অন্যের মনের কথা জানতে গণভোটে দেয়া বেমানান। আবার প্রশ্নটা ওপেন-এন্ডেড।
প্রতি বছর এভাবে যাচ্ছে বলে বিশজ্ঞদের মতামত রয়েছে। আবার অন্য কথাও আছে, ফেসবুকের গণভোট কি আসল ফলাফল তুলে আনতে পারবে? সবাই কি মনের কথা স্পষ্ট করে বলবে? সবার মুখ দেখে কি বুঝা যাবে, ভেতরে ফিক্সড প্রাইসের দোকান, নাকি দামাদামি চলে? পৃথিবীতে মানুষই হচ্ছে একমাত্র জীব যে মনের কথা লুকাতে পারে মুখের কথা দিয়ে। মনের চেহারা লুকাতে পারে মুখের চেহারা দিয়ে।
জোসেফ কনরাডের বিখ্যাত উপন্যাস 'হার্ট অব ডার্কনেস' এর একটা চরিত্র হচ্ছে সেন্ট্রাল স্টেশন বা কেন্দ্রীয় এলাকার ম্যানেজার। এই 'বস' সব কথা বলার পর একটা মুচকি হাসি দেন। হাসিটা একটা সীলমোহর। অন্তরে বিদ্বেষ, কুবুদ্ধি, পরশ্রীকাতরতা মজুদ করে রেখে উপরে সীলগালা করা হাসি দিয়ে আটকে দেন তিনি। তখন কারো সাধ্য নেই, তিনি মনে মনে তখন কী ভাবছেন তা জানার। কাজেই হাসি দেখে মানুষ বিচার করার আগে একটু সময় নিতে হবে। কিন্তু এ কাজ খুবই কঠিন।
ধান বেশি, চাল কম – এমন হলে তাকে বলে ‘ধানের মধ্যে চাল ’। আবার চাল বেশি, ধান কম হলে , তাকে বলে ‘ চালের মধ্যে ধান ’। সংস্কৃতিতে এরকম আছে। সংস্কৃতি যখন আপন গণ্ডি মজবুত করতে ব্যর্থ হয়, তখন বিতর্ক হয় সেসব নিয়ে, যা আদৌ কোনো বিতর্কের বিষয় নয়। কাজী নজরুল ইসলাম কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে বড় মাপের কবি? এমন বিতর্ক মানায় একটা স্তর পর্যন্ত -- কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে তা বেমানান। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে গণভোটে রুচির প্রশ্নে কার পক্ষে বেশি ভোট পড়বে তা বলা কঠিন। কেউ কেউ বলেছেন, নেগেটিভ ভোট পড়ে। সংস্কৃতি জগতের ব্যর্থতার জন্য প্রতিবাদী ভোট হচ্ছে নেগেটিভ ভোট। এরকম গণভোট হলে এবং ভোট ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু হলে, প্রাতিষ্ঠানিক অন্য সব অস্তিত্ববানেরই ভরাডুবি হবে। কারণ, প্রায় সকলেই ব্যর্থতার দায় এড়াতে অসুবিধায় পড়বেন। সবখানে সূর্য হেলে পড়ার কারণে গাছের ছায়া দূরে চলে গেছে। বটতলার ছায়া নিমতলায়। বুঝা মুষ্কিল বটগাছের ছায়া , নাকি নিমগাছের ছায়া।
(গাজী মিজানুর রহমান , লেখক ও প্রবন্ধকার)
মন্তব্য করুন
মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন
মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]