ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

অ্যামনেস্টির বার্ষিক রিপোর্ট

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা

মানবজমিন ডেস্ক
১ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ২০২২ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তুলে ধরে তারা বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে বলেছে, গত বছরটিতে স্বাধীন মতপ্রকাশ ছিল সীমাবদ্ধ। বছরের প্রথম নয় মাসে কমপক্ষে ১৭৯ জন সাংবাদিক হয়তো হয়রানি অথবা প্রতিশোধমূলক আচরণের মুখোমুখি হয়েছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পেশাগত কাজের সময় সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করা হয় অথবা আগে প্রকাশিত খবরের জন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২৭শে মার্চ প্রকাশিত ওই রিপোর্টে বলা হয়, বছরজুড়েই পুলিশ বেশ কয়েকটি বিক্ষোভ দমন করেছে। গত এক দশকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক গুমের হার ছিল উচ্চ। এতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ সফরের সময় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জোরপূর্বক গুম হওয়া থেকে সবব্যক্তির সুরক্ষার জন্য কনভেনশন অনুমোদনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এতে আরও বলা হয়, নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন এবং অন্যান্য দুর্ব্যবহারের অভিযোগ ছিল একই রকম। মত প্রকাশের স্বাধীনতা অংশে বলা হয়েছে, ভিন্নমত এবং সমালোচনাকে দমিয়ে রাখতে সরকার বার বার ব্যবহার করেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ)।

বিজ্ঞাপন
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগে সাইবার ট্রাইব্যুনাল বরাবর এক বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে ২২৪৯টি। 

জানুয়ারি এবং নভেম্বরের মধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ১১৪টি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলা নথিভুক্ত করেছে আর্টিকেল ১৯। তারা খুঁজে পেয়েছে যে, এর মধ্যে ৭৮টি মামলা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া পোস্ট সংক্রান্ত। এর মধ্যে ৪৬টি মামলা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক ফজলে এলাহির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মানহানি, আপত্তিকর, মিথ্যা ও হুমকি দেয়ার তথ্য প্রকাশের অভিযোগে পৃথক মামলা করেন আওয়ামী লীগের সাবেক একজন এমপি ও তার মেয়ে। এ মামলায় জুন মাসে গ্রেপ্তার করা হয় ওই সাংবাদিককে। ফজলে এলাহি একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে সাবেক ওই সংসদ সদস্য ও তার মেয়ের দ্বারা ইজারা দেয়া একটি সরকারি সম্পর্কিত অনিয়ম ও অপব্যবহারের বর্ণনা ছিল। অনলাইন নিউজ পোর্টাল নেত্র নিউজের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আগস্টে মামলা করেন আওয়ামী লীগের রংপুর জেলা শাখার সহ-সভাপতি। দেশের  একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন কারাগার সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে এই মামলা করা হয়। মামলায় বলা হয়, এর মাধ্যমে ওয়েবসাইটটি ‘গুজব প্রচার করছে’। কথিত ওই গোপন কারাগার  থেকে বেঁচেযাওয়া এক ব্যক্তির বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। অ্যামনেস্টি আরও বলেছে, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মত প্রকাশের স্বাধীনতাও সীমিত করার চেষ্টা করেছে কর্তৃপক্ষ। মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা অধিকার-এর নিবন্ধন নবায়নের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো। কারণ হিেেসবে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, হত্যা সম্পর্কে ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য’ প্রকাশ করেছে অধিকার। এতে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ‘কলঙ্কিত’ করেছে তারা। 

অ্যামনেস্টি আরও বলেছে, জানুয়ারিতে সিলেটে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে পদত্যাগের আন্দোলন করেন শতাধিক শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের অবরোধ ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশি দমনের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। পরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে পুলিশ। শব্দ গ্রেনেড ব্যবহার করে। রাবার বুলেট ব্যবহার করে। এতে বেশকিছু শিক্ষার্থী আহত হয়। মামলা হয় ২০০ জনের বিরুদ্ধে। ফেব্রুয়ারিতে একটি কারখানা বন্ধের প্রতিবাদ করেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছোড়ে। মার্চে অত্যাবশ্যক সেবা এবং মৌলিক পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় পুলিশ বাম সংগঠনগুলোর বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে। জুনে কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে ২০১৮ সালের নির্ধারিত জাতীয় মাসিক ন্যূনতম মজুরি ৮০০০ টাকা থেকে বাড়ানোর দাবি করেন। এ সময় তাদের দমন করে পুলিশ। ডিসেম্বরে ঢাকায় দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয় বিএনপি’র সদর দপ্তরের বাইরে। তারা কিছুদিন আগে ক্ষমতাসীনদের পদত্যাগের দাবিতে রাজনৈতিক সমাবেশের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। তাদের দাবি একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যারা সামনের জাতীয় নির্বাচন তদারক করবে। হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর ওপর পুলিশ গুলি চালানোয় একজন নিহত হন। আহত হন ৬০ জন। ডিসেম্বরের প্রথমভাগে সারা দেশে পুলিশ ২৩,৯৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে বিরোধী দলের কয়েকশ’ নেতাকর্মী আছেন। 

অ্যামনেস্টি আরও বলেছে, সুশীল সমাজের সংগঠন অধিকার আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, বছরের প্রথম নয় মাসে নিরাপত্তা হেফাজতে ৫৪ জনের মৃত্যুর অভিযোগ রয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে এর মধ্যে ৩৪ জনকে বিচার চলাকালীন আটক করা হয়। চুরির অভিযোগে একজন অভিযুক্ত পুলিশি হেফাজতে মারা যান। বিষয়টি ব্যাপক প্রচার পায়। পুলিশ দাবি করে তিনি নিজে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। তবে নিহতের স্ত্রী জান্নাত আক্তারের অভিযোগ, তাকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা টাকা পরিবার দিতে না পারায় তাকে পিটিয়ে হত্যা করা। অধিকারের হিসাবে বছরের প্রথম নয় মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছেন অন্তত ২৫জন। জোরপূর্বক গুম হয়েছেন ১৬ জন। আগের বছরের তুলনায় এই সংখ্যা কম হলেও ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিধোজ্ঞার পরও উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে।  আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, কমপক্ষে ৯৩৬ জন নারী ও মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্যদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছন ২৯২ জন নারী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ক্যাম্পাসের ভিতরেই যৌন নিপীড়ন ও নগ্ন করে ৫ জন পুরুষ। সেই ৫ জন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত। তারা ওই ছাত্রীকে ধারণ করা ভিডিও প্রকাশ করে দেয়ার হুমকি দেয়। তদন্তের পর ৫ যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে অন্তত দু’জন ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে নিবন্ধিত। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ নিষ্ক্রিয় থাকে। এর প্রতিবাদ করেন সহশিক্ষার্থীরা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া ওই প্রতিবেদনে অন্যান্য বিষয়ে মানবাধিকার নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। 

অ্যামনেস্টির রিপোর্টে শ্রমিকদের অধিকার প্রসঙ্গে বলা হয়, গত এক দশকে নানা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং পরিবর্তন সত্ত্বেত্ত শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হয়নি। সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির হিসাবে, ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে ২৪১ টি কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৩৩৩ জন কর্মী নিহত হয়েছে। এর আগের বছর ২০২১ সালের একই সময়ের মধ্যে মারা গিয়েছিল ৩০৬ জন। জুন মাসে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লেগে কমপক্ষে ৪৯ জন শ্রমিক নিহত এবং ২৫০ জন আহত হয়। রিপোর্টে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সমপ্রদায়গুলোও বিভিন্ন ধরনের জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছে।
 

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status