ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

মুরগি-ডিমের বাজারে অস্থিরতার নেপথ্যে-

সিরাজুস সালেকিন
৩০ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার
mzamin

মুরগি ও ডিমের বাজারে অস্থিরতা কাটছে না। গত দুই  মাসে মুরগির দাম বেড়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ। ডিমের দাম বাড়তে বাড়তে প্রায় দ্বিগুণ হওয়ার পথে। নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের বাজারের তালিকা থেকে বাদ পড়ার পথে মুরগি ও ডিম। এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হচ্ছে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এ অবস্থায় সরকারের কয়েকটি সংস্থা নড়েচড়ে বসলেও নিশ্চুপ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। শুধু উৎপাদনেই নজর সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের। মুরগি ও ডিমের বাজারে অস্থিরতার মধ্যে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। সেখানে সুলভ মূল্যে মাংস, দুধ ও ডিম বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নজরদারির অভাবে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছামতো মুনাফা করছে।

বিজ্ঞাপন
বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানই বাজারের নিয়ন্ত্রক। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মুরগির বাচ্চা ও ডিমের মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি রয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের। তবে এই কমিটি নামমাত্র। প্রায় এক যুগের বেশি সময় আগে গঠিত এই কমিটি মুরগির বাচ্চা ও ডিমের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য একটি কৌশল পত্র প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি এক যুগেও। সাম্প্রতিক সময়ে ডিমের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলে ৫ই ডিসেম্বর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সেক্টরের সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা করে। সভায় মুরগির বাচ্চার দাম নির্ধারণের বিষয়ে উদ্যোগ নিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রতি পরামর্শ রাখেন উপস্থিত বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. এমদাদুল হক তালুকদার বলেন, পোল্ট্রি সেক্টরে আমরা উৎপাদক। মূল্য নির্ধারণের কাজ আমাদের না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যদি আমাদের এই কাজে যুক্ত করে তবেই আমরা তা করবো। আমরা উৎপাদন খরচ নিয়ে কথা বলতে পারি। উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত বিপণনে মিনিমাম কতটুকু লাভ করা যেতে পারে তা পরামর্শ দিতে পারি। কিন্তু আমরা মূল্য নির্ধারণ করতে পারি না। সাম্প্রতিক সময়ে একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ৯৩৬ কোটি টাকা লুটের যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে তার হিসাব কীভাবে করা হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে জানান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. এমদাদুল হক তালুকদার। বলেন, তারা কীভাবে এটা ক্যালকুলেশন করলো তা আমাদের জানা নেই। প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩৫০০ টন। প্রান্তিক খামারিদের এখন প্রতি কেজি মুরগি উৎপাদনে খরচ পড়ে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা, আর কর্পোরেট কোম্পানিদের উৎপাদন খরচ পড়ে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। তবে পাইকারি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত এসব মুরগি বিক্রি হয়েছে। তাতে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা করেছে কেজি প্রতি অন্তত ৬০-১০০ টাকার মতো। প্রতিদিন মোট চাহিদার ২০০০ টন মুরগি বাজারে আসে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। সেই হিসাবে প্রতি কেজিতে ৬০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা ধরলে এসব কোম্পানির দৈনিক মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ কোটি টাকায়। সংগঠনটির দাবি, এভাবে গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ৫২ দিনে মুরগি বিক্রির মাধ্যমে ৬২৪ কোটি টাকা লাভ করেছে কোম্পানিগুলো। আর মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে মুনাফা করেছে ৩১২ কোটি টাকা। সংগঠনটির সভাপতি সুমন হাওলাদার এর হিসাব দিতে গিয়ে বলেন, দেশে প্রতিদিন মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হয় ২০ লাখ। এসব বাচ্চা কোম্পানিগুলো উৎপাদন করে। একেকটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে খরচ হয় ২৮ থেকে ৩০ টাকা, যা চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ছিল ১০ থেকে ১৫ টাকা। গত ৩১শে জানুয়ারি থেকে ২৩শে মার্চ পর্যন্ত মুরগির বাচ্চা ৬২ থেকে ৬৮ টাকা দরে বিক্রির বিষয়ে বার্তা দেয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে তা বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। সে হিসাবে প্রতিটি বাচ্চায় কোম্পানিগুলো ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করছে বলে দাবি বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের। এভাবে মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে সাধারণ ভোক্তাদের কাছ থেকে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ৯৩৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করেছে বলে তারা জানিয়েছে। সংগঠনটির অভিযোগ, সরকারি তদারকির অভাবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এই হরিলুট করছে। সাম্প্রতিক সময়ে মুরগির দাম কেজিতে ২৯০ টাকায় উঠে গেলে ‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের বড় চারটি মুরগি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তাদের কাছে ব্রয়লার মুরগির ‘অযৌক্তিক’ মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চাওয়া হয়। আলোচনার একপর্যায়ে কোম্পানিগুলো রোজার মাসে ব্রয়লার মুরগির দাম কমিয়ে খামার থেকে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায় বিক্রি করার কথা জানায়। যা আগে ছিল ২২০-২৩০ টাকা। ভোক্তা অধিকারের সঙ্গে আলোচনার পরপরই মুরগির দাম এক লাফে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কমানো এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। প্রান্তিক চাষিদের দাবি, কোম্পানিগুলো এতো বেশি হারে মুনাফা করছে যে সরকারি সংস্থাকে ঠাণ্ডা রাখতে তারা সাময়িক মুনাফা এক লাফে এতোটা কমিয়ে আনতে পেরেছে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে ব্রয়লার মুরগির বাজার অস্থির হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ প্রান্তিক খামারিদের। সরকার যদি প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদনে না ফেরায়, সুরক্ষা না দেয়, বাজার প্রতিযোগিতায় না থাকে তাহলে বাজার কর্পোরেটদের কাছে জিম্মি হয়ে যাবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, পোল্ট্রির সব পণ্যের উৎপাদন খরচ সমন্বয় করে সরকার যেন ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক এবং পোল্ট্রি স্টক হোল্ডারদের সমন্বয়ে ‘পোল্ট্রি উন্নয়ন ডেভেলপমেন্ট বোর্ড’ গঠনের সুপারিশ করেছি আমরা। বোর্ডের কাজ হবে ফিড ও মুরগির বাচ্চার উৎপাদন খরচ বুঝে ন্যায্য দাম নির্ধারণ করে দেয়া। সব পর্যায়ে নির্ধারিত দাম মানা হচ্ছে কিনা তা কঠোরভাবে নজরদারি করার তাগিদ দেন তিনি, যেন কেউ টাকার কাছে হার না মানে। কর্পোরেট গ্রুপের ওপর নির্ভর না করে সরকারি হ্যাচারি ও ফিড মিল চালু করে মুরগির বাচ্চা ও পোল্ট্রি ফিড খামারিদের কাছে ন্যায্য মূল্যে সরবরাহ করার পরামর্শ দেন তিনি।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status