ঢাকা, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

ডলার প্রতারক জাকিরের বিলাসী জীবন

শুভ্র দেব
২৯ মার্চ ২০২৩, বুধবার
mzamin

জাকির হোসেন ফেসবুকে পণ্য ক্রয়ের একটি বিজ্ঞাপন দেখেন। পরে তিনি ওই পেজের মেসেঞ্জারে নক করেন। মেসেঞ্জারে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি পণ্যের জন্য তাকে বিকাশে টাকা পাঠাতে বলে। জাকির তার কথামতো একটি বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু মেসেঞ্জারে যে ব্যক্তি তাকে টাকা পাঠানোর কথা বলেছিল সে পণ্য না দিয়েই জাকিরকে ব্লক করে দেয়। প্রতারণার শিকার জাকির পরে ওই কৌশল আয়ত্ত করে নিজেই প্রতারক হয়ে ওঠে। সে বিভিন্ন নামে-বেনামে ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে টাকার বিনিময়ে ডলার বিক্রির বিজ্ঞাপন দিতে থাকে। পরে ভুক্তভোগীরা যখন ডলার ক্রয়ের জন্য জাকিরের সঙ্গে যোগাযোগ করতো তখন সে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা এনে তাদের মেসেঞ্জারে ব্লক করে দিতো। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে ফ্রিল্যান্সারদের টার্গেট করে ডলার দেয়ার নাম করে জাকির বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ফেসবুকে ডলার বিক্রির নাম করে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া টাকা দিয়ে বিলাসী জীবন যাপন শুরু করে।

বিজ্ঞাপন
তবে রেহাই মেলেনি। এক ভুক্তভোগীর মতিঝিল থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ (দক্ষিণ)। খিলক্ষেত থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাকিরকে গতকাল গ্রেপ্তার করা হয়। 

ডিবি জানায়, জাকির একাই ডলার প্রতারণার কাজ করতো। দেশে অনেক ফ্রিল্যান্সার রয়েছে যাদের প্রতিনিয়ত তাদের কাজের জন্য বিভিন্ন অনলাইন অ্যাকাউন্টে ডলার রিসিভ ও পেমেন্ট করতে হয়। ডলার রিসিভের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যা না হলেও, ডলার দিয়ে অনলাইনে ফেসবুক এডস, ডোমেইন, সার্ভার, ক্লায়েন্ট রিফান্ড ইত্যাদির পেমেন্ট করতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতি ট্রান্সজেকশনে সর্বোচ্চ ৩০০ ইউএস ডলার পেমেন্ট করা যায়। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ ফ্রিল্যান্সারদেরই এলসি করে ডলার পাঠানোর সুযোগ নাই। কারণ একদিকে অ্যামাউন্ট কম থাকে, অন্যদিকে প্রত্যেকেই অনলাইন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পেওনিয়ার, পেপাল ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এসব অ্যাকাউন্টে ডলার নেয়ার কোনো উপায় নেই। ফলে শুধুমাত্র অ্যাকাউন্ট টু অ্যাকাউন্ট পেমেন্ট বা সেন্ড মানি করা সম্ভব হয় এবং এটাই একমাত্র উপায়। আর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জাকির কিছু মানুষের ছবি দিয়ে ‘অমিত বর্মণ কল্লোল, সিদ্দিকুর রহমান, জুবায়েদ আহম্মেদ আনসারী, চন্দন বিশ্বাস পুলক, খান মুহাম্মদ সাব্বির, কার্তিক দাস, আতিকুর রহমান রাসেল, আব্দুল কাদের, নাবিল হোসেন মধু, জিআর পলাশ, স্বাধীন দেওয়ান’ এ ছাড়াও সর্বমোট ২৬টি ফেইক ফেসবুক প্রোফাইল খুলে প্রতারণা করে। প্রোফাইলগুলো এমনভাবে সাজায় যাতে মনে হয় এগুলো কোনো ফ্রিল্যান্সারের অ্যাকাউন্ট। 
ডিবি জানায়, এরপর জাকির এই আইডিগুলো ব্যবহার করে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে ফ্রিল্যান্সার খুঁজে সবাইকে ফ্রেন্ড রিক্যুয়েস্ট পাঠাতে থাকে। আসামির প্রোফাইল একজন ফ্রিল্যান্সারের প্রোফাইলের মতো করে সাজানোয় অনেকেই আসামির ফ্রেন্ড রিক্যুয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে। এতে আসামি বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সারদের ফ্রেন্ডলিস্ট ও মিউচ্যুয়াল ফ্রেন্ড লিস্ট এ ঢুকে যায়। জাকির তাদেরই টার্গেট করার জন্য টাকার বিনিময়ে ফেসবুকে ডলার বিক্রির স্ট্যাটাস দেয়। এতে কেউ ডলার কিনতে চাইলে তার সঙ্গে খুব সুন্দর করে কথা বলে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জাকির বিকাশে টাকা চাইতো। যখন সরল বিশ্বাসে কোনো ফ্রিল্যান্সার টাকা পাঠাতো তখন তাদেরকে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ব্লক করে দিতো। এজন্য জাকির একাধিক সিম ব্যবহার করতো। একজনের সঙ্গে একটি সিম দিয়ে প্রতারণার পর সেটি বন্ধ করে দিতো। এতে করে ভুক্তভোগীরা মেসেঞ্জার বা মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করতে পারতো না। 
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেন, এভাবে প্রতারণার ফাঁদ পেতে জাকির ‘অমিত বর্মণ কল্লোল’ নামের আইডি’র মাধ্যমে ৫ লাখ,  ‘সিদ্দিকুর রহমান’ আইডি দিয়ে ৪ লাখ, ‘জুবায়েদ আহম্মেদ আনসারী’ দিয়ে ২ লাখ ৭৭ হাজার, ‘চন্দন বিশ্বাস পুলক’ দিয়ে ৬ লাখ ১০ হাজার, ‘খান মুহাম্মদ সাব্বির’  দিয়ে ৩ লাখ ৮০ হাজার, ‘কার্তিক দাস’ দিয়ে ২ লাখ ১৩ হাজার, ‘আতিকুর রহমান রাসেল’ দিয়ে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৩১৮, ‘আব্দুল কাদের’ দিয়ে ১ লাখ ৪১ হাজার ৫০০, ‘নাবিল হোসেন মধু’ দিয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার, ‘জিআর পলাশ’ দিয়ে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫১৮ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এভাবে অন্তত ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। 

বাদী ইহসান ইফতেখার লাবীব মামলায় বলেন, তিনি অনলাইনে একজন ওয়েব-ডেভেলপার হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং করেন। সার্ভার, ডোমেইন, ইত্যাদির বিল পরিশোধের জন্য তিনি তার পেওনিয়ার অ্যাকাউন্টে টাকার বিনিময়ে ডলার ক্রয় করতে চান। সেই ক্ষেত্রে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ডলার বিক্রির একটি পোস্ট দেখে ডলার ক্রয়ের জন্য মেসেঞ্জারে কথা বলেন। অজ্ঞাতনামা ফেসবুক ব্যবহারকারী ব্যক্তি রাজি হয়ে তাকে বিকাশে টাকা পাঠাতে বলে। পরে তিনি ইসলামী ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর কথা জানান। তখন অজ্ঞাতনামা ডলার বিক্রেতা বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বললে ইফতেখার আর ডলার ক্রয় করেননি। কিন্তু তার ডলারের বিশেষ প্রয়োজন হওয়াতে তিনি পুনরায় ওই আইডিতে নক করেন। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিকাশে ৩০০ ডলার ক্রয়ের জন্য ৩০ হাজার ৯০০ টাকা পাঠিয়ে দেন। কিন্তু টাকা পাওয়ার পর অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি তার পেওনিয়ার অ্যাকাউন্টে ডলার পাঠায়নি। তাই তিনি ওই ব্যক্তির মেসেঞ্জারের নক করতে গিয়ে দেখেন তাকে ব্লক দেয়া হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও তার আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে ইফতেখার বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। 
ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুর রহমান আজাদ মানবজমিনকে বলেন, জাকির নিজেই এক সময় অনলাইন প্রতারণার শিকার হয়েছিল। পরে সে নিজেই প্রতারক হয়ে ওঠে। ফ্রিল্যান্সারদের টার্গেট করেই প্রতারণা করতো। ভুয়া আইডি থেকে ডলার বিক্রির বিজ্ঞাপন দিতো। ফ্রিল্যান্সারদের বিভিন্ন প্রয়োজনে পেমেন্ট করার জন্য ডলারের প্রয়োজন হলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতো। কিন্তু প্রতারক জাকির টাকা পাওয়ার পর ভুক্তভোগীকে মেসেঞ্জারে ব্লক দিয়ে যে মোবাইল নম্বরে টাকা নিতো সেটি বন্ধ করে দিতো। এভাবে প্রতারণা করা টাকা দিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছিল। তিনি বলেন, ট্রান্সপার ওয়াইজ, পেওনিয়ার, পেপালে লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। ফ্রিল্যান্সার ব্যক্তিরা ডলার ট্রান্সজেকশনের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত বৈধ চ্যানেল ব্যবহার করে লেনদেন করলে এই সমস্যা হবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কোনো প্রকার অর্থ লেনদেন থেকে বিরত থাকতে হবে এবং যাচাই-বাছাই না করে বিকাশ কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে কারও কাছে ডলার ক্রয় করা যাবে না। এ ছাড়া ই-ট্রান্সজেকশনের ক্ষেত্রে কাকে টাকা দিচ্ছেন তার সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে ধারণা নিতে হবে।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status