মত-মতান্তর
স্বাধীনতার ৫২ বছর পর কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা?
ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন
(২ মাস আগে) ২৭ মার্চ ২০২৩, সোমবার, ৯:২০ অপরাহ্ন

২৬শে মার্চ, ২০২৩। বাংলাদেশ নামের এই ভুখন্ডের স্বাধীনতা ঘোষণার ৫২ বছর পূর্তি হতে চলেছে। পৃথিবীতে এমন অনেক নজির হয়তো পাওয়া যাবে, যেখানে একটি পরাধীন জনগোষ্ঠী অধীনতার শিকল ছুঁড়ে ফেলার মানসে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বছরের পর বছর লড়াই করে গেছে, কিন্তু স্বাধীনতার সোনার হরিণ তাদের কাছে অধরাই থেকে গেছে। এক্ষেত্রে প্রিয় মাতৃভূমি সোনার বাংলাদেশ এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম- স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ৯ মাসের মাথায় রনাঙ্গনের যুদ্বে দখলদার বাহিনীকে পরাভূত করে এদেশের দামাল ছেলেরা বিজয়ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল।
'৭১-এর ৭ই মার্চ সেদিন রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠে দৃপ্ত উচ্চারণ 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' এই ইঙ্গিতই বহন করছিল যে, চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিনক্ষণ সমুপস্থিত।
২৫শে মার্চের সেই কালো রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে উল্টো তাকে আটক করে নিয়ে যায়, স্বাধিকারের লক্ষ্যে পরিচালিত এতদিনকার রাজনৈতিক সংগ্রাম স্বয়ংক্রিয়ভাবেই স্বাধীনতার যুদ্ধে রূপ নেয়। আকস্মিক আক্রমণে হতচকিয়ে উঠলেও সংগ্রামী জনতার ঘুরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে খুব একটা বিলম্ব হয়নি। সেনা, পুলিশ, ইপিআর, আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত বাঙ্গালী সদস্যরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এই জনযুদ্ধে শামিল হতে শুরু করে। ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত বঙ্গবন্ধুর বেতার বার্তা এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রামে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তৎকালীন মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন আজীবন স্বাধীনচেতা একজন সংগ্রামী জননেতা। গণতন্ত্র ও সম-অধিকারের দাবিতে পরিচালিত তার দীর্ঘ আপোসহীন সংগ্রাম এদেশের মানুষকে আত্মশ্লাঘায় উজ্জীবিত করে স্বাধীনভাবে সম্মানের সাথে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। '৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় তাকে এ সংগ্রামের অবিসংবাদিত সিপাহসালারে পরিণত করে। তিনি এই প্রশ্নে আপামর জনসাধারণের মধ্যে এক ইস্পাত-কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে দেশের হাল ধরেন, তিনি একজন স্টেটসম্যান হিসেবে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার এবং যুদ্ধকালীন বৈরিতা ভুলে গিয়ে বিশ্বের সব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের ব্যাপারে নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করে তিনি এ বার্তাই কী দেননি যে, পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে যুদ্ধকালে সহায়তা দানে আগত সকল ভারতীয় সেনাকে ফেরত পাঠিয়ে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা তার আজীবনের স্বাধীনচেতা মনোভাব ও পর্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্বের জন্যই কি সম্ভব হয়নি? মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে কারও চোখ রাঙ্গানির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। শুধু কি তাই? ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে পাক হানাদারদের পরিচালিত গণহত্যার মূল কুশীলব, পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানোর যে দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছিলেন, তা ওই মুহুর্তে আর কারও পক্ষে কি সম্ভবপর ছিল?
আজ আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে, আজকের করণীয় নির্ধারণে আমরা '৭১-এর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর ইতিহাসকে কতটা সামনে রাখছি। একবার ভেবে দেখুন তো, স্বাধিকারের সংগ্রাম স্বাধীনতার যুদ্ধে রূপান্তরের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক কী ছিল? '৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অস্বীকৃতিই নয় কি? দুর্ভাগ্যবশত, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমরা ক্ষমতার পালাবদলের জন্য সবার নিকট গ্রহণযোগ্য একটি পদ্ধতি গড়ে তুলতে পারিনি। আমরা যেন বানরের পিচ্ছিল বাঁশে আরোহনের মতো এক পা এগিয়ে ফের দুই পা পিছিয়ে পড়ার মহরত চালিয়ে যাচ্ছি অবিরত।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে। আর আমরা মেতে উঠেছি জাতিকে নানা অভিধায় বহুধা বিভক্ত করে এক অনন্ত যুদ্বের আত্মবিনাশী খেলায়। বঙ্গবন্ধু তার ইস্পাত কঠিন ব্যক্তিত্বের গুণে কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্বকে জানান দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ তার সিদ্ধান্তগুলো নিজেই নেবে। আর আমরা অনবরত নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত হয়ে বারবার বহিঃশক্তিকে ডেকে আনছি আমাদের সালিশ-নিষ্পত্তি করতে। মানুষের বড় সীমাবদ্ধতা হলো, সে ভবিষ্যত দেখতে পায় না। পলাশীর আম্রকাননে ক্ষমতার মোহে সেদিন যারা জাতির সাথে বেইমানি করেছিল, তারা কি ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পেরেছিল, এই পরাজয়ের মধ্য দিয়ে জাতি দুশ’ বছরের জন্য বহিঃশক্তির গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হতে চলেছে? আমাদের অন্তর্কলহের সুযোগে কি আজ বাংলাদেশ আমেরিকা, ভারত, চীন ও রাশিয়ার মতো বহিঃশক্তি সমূহের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হতে চলছে না? এর পরিণতি কি কারও জন্যেই ভালো হবে? কবে আমাদের সুবিবেচনার জাগরণ ঘটবে?
সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক: অধ্যাপক ও সভাপতি, ফার্মেসী বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।