ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

রম্য

মোবাইল ফোন কাহিনী

গাজী মিজানুর রহমান

(১ বছর আগে) ১৭ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ৫:২৫ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৯:২৮ পূর্বাহ্ন

mzamin

গাজী মিজানুর রহমান, লেখক ও প্রাবন্ধিক

এশিয়া মহাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ায় ইন্টারনেট ব্যবহারের হার সবচেয়ে বেশি। তারপর রয়েছে জাপান এবং মালয়েশিয়ার অবস্থান। ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক দিয়ে সিঙ্গাপুরের চেয়ে মালয়েশিয়া উপরে। কেউ যদি কুয়ালালামপুর সিটিতে চলাচলকারী এল আর টি/এমআরটিতে ওঠেন ওঠেন, দেখবেন, ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জনের চোখ মোবাইলের পর্দায় নিবদ্ধ। তারা এ সময়  কোনো না কোনো সামাজিক সাইট বা ভিডিও গেমে মশগুল থাকেন। দাঁড়িয়ে থাকা যাতায়াতকারীদেরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছেলে-মেয়ে এক হাত দিয়ে কাজ সারছে। রেলের বগি সামান্য দুলছে, তাতে নেটিজেনের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। 

যে-সব দেশে ব্যাপক হারে ইন্টারনেট পেনিট্রেশন হয়েছে, সেসব দেশের মেট্রোপলিট্যান সিটিগুলির নানা কিসিমের ভবনের কোরিডোর ক্লিন করে যেসব কর্মীরা তাদের অনেককেই দেখা যায়, ৫০ ফুট ব্রাশ মেরে এসে পকেট থেকে ফোন বের করে মিনিট খানেক দেখে, তারপর ঝাড়ামোছার পরের রাউন্ডে লগ ইন করে। তা না হলে মাথা হ্যাংড হয়ে যায়। প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর এই দেখাটা তার ব্রেনের কাছে ক্যাস্পারস্কি ভাইরাস প্রটেকশন এর মত কাজ করে বলে অনেকে মন্তব্য করেন। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার ৭৭% এর উপরে।

বিজ্ঞাপন
এই হারকে সম্মানজনক অবস্থান বলা যায়। এই ব্যবহারকারীদের সিংহভাগ মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী।

কিন্তু ব্যবহার যত বাড়ছে মোবাইল সেট নিয়েও বিপত্তি তত বাড়ছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে সেট হারানো। ১০-১৫ বছর যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন, তাদের প্রত্যেকে গড়পড়তা ৩-৪ টি সেট খুইয়েছেন। ঢাকার বাস টার্মিনাল গুলিতে এবং বেশি জ্যাম-প্রবণ এলাকায় অদ্ভুত কায়দায় সেট চুরি হয়। ক্রিড়ানিপুণ ছিনতাইকারী আন্তর্জাতিক মানের শারীরিক কসরত দেখিয়ে বাসের জানালায় লাফিয়ে ওঠে। তারপর ঈগল পাখির মত ছোঁ মেরে মোবাইল সেট নিয়ে অলিম্পিক ক্রিড়ায় অংশ নেয়া স্প্রিন্টার এর গতিতে উধাও হয়ে যায়। 

অন্যদিকে লালমাটিয়ার এক যুবকের  প্রথমবার হারানো সেটের কেচ্ছা অন্যরকম। ক্লাস নাইন-টেনে পড়ার সময় দৃষ্টিনন্দন কায়দায় তার মোবাইলের হাতবদল ঘটেছিল। পড়তো ল্যাবরেটরি স্কুলে। পাশের একটা বড় কলেজের এক ছাত্র এসে বললো, দেখি তোর সেটটা। স্কুল- ছাত্র ভাবলো, কলেজের বড় ভাই, দেখতে চায়, দেখেটেখে দিয়ে দেবে। কিন্তু সে দেখতে দেখতে পকেটে ঢুকিয়ে হেঁটে চলে গেল। জুনিয়র বালকের কি আর অত সাহস ছিল সেই মোবাইল-সেট ফেরত চাইবে? 

ধানমন্ডির বাসিন্দা মধ্যবয়েসী এক ব্যক্তি গিয়েছিলেন কল্যাণপুর বাস  স্টপেজে পরিবহন কোম্পানির বাস থেকে মেয়েকে নামাতে। গাড়ির পেছনের সিটে মোবাইল রেখে গাড়ি থেকে নেমে মেয়েকে আনতে গেলেন তিনি । ড্রাইভারও নেমে গোলো লাগেজ ধরতে। মাঝখানে গাড়ি থেকে মোবাইল সেট উধাও। দরজা খোলা রেখে ড্রাইভার কেন এলো -- এ প্রশ্নের কোনো সমাধান তিনি পাননি। আরেকবার দোকানে এক বোতল পানি কিনে ফোন সেট রেখে চলে আসেন। ১০০ গজ সামনে এসে মনে পড়লো মোবাইল সেটের কথা। ফিরে গিয়ে দোকানীকে জিজ্ঞেস করে কোনো সদুত্তর পাননি। তখনকার দিনে  মাওয়া ঘাটের লম্বা শেডের মধ্যে সারি সারি দোকান ছিল। আহা! তখন যদি এখনকার মত ব্রিজ থাকতো, দোকানদার কি এভাবে মেরে দিয়ে বলতে পারতো, দেখি নাই তো ? অভিশাপ খেয়ে ব্যবসা তো গেল, খাও না এখন পরের জিনিস! তবে জিনিস না হারানো নিশ্চিত করার পলিসি হলো, দুই-তিন জেনারেশন আগের মাল ব্যবহার করা, যার উপরে চোরের চোখ এসে পড়লেও পিছলে যাবে। চোর এসে নেড়েচেড়ে দেখে মনে মনে বলবে , এই লোকের শরীরে কি গরীব চোরের জন্য একটু মায়াদয়া নেই ? এই ফোন চোরাই বাজারে বিক্রয় করলে গতরখাটা পয়সা ও তো হবে না ! আজকালের দুনিয়ায় এ-ও মানুষ সখের আঙ্গুল দিয়ে টেপাটিপি করে ?

অমিতাভ বচ্চন কৌন বনেগা ক্রোড়পতি উপস্থাপন করার সময় কম্পিউটারকে বলতেন, ‘কম্পিউটার সাহেব’! আসলে কম্পিউটার /মোবাইল ব্যক্তি হয়ে উঠছে। কালে কালে সে মানুষের কাজের মধ্যে চেপ্টা নাক ঢুকিয়ে জায়গা দখল করে নিচ্ছে। গুগুল ম্যাপ দেখে গাড়ি চালানো বিদেশে এখন নিত্যনৈমিত্তিক   ব্যাপার হয়ে গেছে। হেঁটে হেঁটে কোথাও যাবেন , গুগুল ম্যাপ -- জায়গা কোনদিকে বলতে পারে কম মানুষ—ওরা শুধু ম্যাপ চেনে, আর ম্যাপটা থাকে মিনি পর্দায়। আমাদের মেট্রোপলিট্যান সিটিগুলিতে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা গুগুল ম্যাপ দেখে গন্তব্যস্থল খোঁজে । তবে গলি-ঘুপচি এত বেশি যে গুগুল সাহেবের যথেষ্ট বেগ পেতে হয় নিশ্চয়ই । গুগুল বা এই সব কোম্পানি যে-সব দেশের, তাদের কাছে সবার তথ্য জড় হচ্ছে। একসময় এই তথ্য তাদের হাতে মারাত্মক অস্ত্র হয়ে যাবে। তেল দেবো না ব'লে মধ্যপ্রাচ্য যেমন হুমকি দিতে পারে , তেমন করে নেট দেব না ,ম্যাপ দেখাবো না ,  ব'লে www-রা যদি হুমকি দেয়, তাহলে  মোবাইল আর এদের পেটের বিদ্যেবুদ্ধি-খেকো টেকনোলজি- নির্ভরতা বৈশ্বিক সম্পর্কে বিরাট ভূমিকা রাখবে।

পৃথিবীতে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি কোথাও নেই । সুখের সাথে বাই-প্রডাক্ট হয়ে আসে দুঃখ । সুখ যখন নেই – সে একরকমের অভাব  , আর সুখ হাতে এসে গেলে বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুঃখ অন্যরকম কষ্টের । শুনেছি , মাঝে মাঝে  ইচ্ছে করে নেটের গতি কমিয়ে দেয়া হয় – তখন নেট-ব্যবহারকারী  ইয়াং জেনারেশনের  অবস্থাটা কেমন হয় , ভাবা যায় ! মোবাইল ফোনের সেট নিয়ে তখন ওরা ছাদে ওঠে একবার, আর মাঠের মধ্যে যায় আরেকবার ।  এরপর রয়েছে  প্রযুক্তির ছিনিমিনি বা ফ্লার্ট করা চরিত্র।  ফোন ব্যবহার করতে লাগে কত রকমের এপ্লিকেশন । নেটে ঢুকে কোনো সেবা নেবেন , কিছু পড়বেন – বিজ্ঞাপনের কারসাজি তো আছেই । আরও আছে নানা চালাকি ।  দুই প্যারা পড়িয়ে বলবে, পুরো পড়তে সাবস্ক্রাইব করুন। অনেকে বলে, ইটস ফ্রি, ‘সাইন আপ প্লিজ’ – মানে একাউন্ট খুলুন।  একাউন্ট খুলতে গেলে  বলবে , এক মাস, এক বছর এর চাঁদা  এত—   দয়া করে দিন। কেউ কেউ ভদ্রতা করে বলে , এক মাস ফ্রি থাকবে। তবে এটা  শপিং মলের অনেক দোকানের ৫০% ডিসকাউন্টের মত ব্যাপার । ৪০ টা র্যানকের একটা র্যা কের মাল ৫০ % কম দামে বিক্রয় হবে  , তাও সেগুলি  বহু পুরোনো এবং অচল টাইপের । তাই বলে কি কিছু থেমে আছে ? চিরকাল ধরে একপক্ষে ঠকে , আর একপক্ষ জেতে । কেউ ঠকে কষ্ট পায় আর কেউ জিতে আনন্দ পায় । তবে চূড়ান্ত লাভবান কে – তা এদের কেউ-ই জানেন না ।

(গাজী মিজানুর রহমান , লেখক ও প্রাবন্ধিক)

 

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status