ঢাকা, ৩ মে ২০২৪, শুক্রবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন

নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে ১১টি দুর্বৃত্ত গ্রুপ

কাজী সোহাগ
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার

বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের (এফডিএমএন) ক্যাম্পে ১১টি সক্রিয় সশস্ত্র দুর্বৃত্ত দল তৎপর রয়েছে। এসব দলগুলোর মধ্যে আরসার উপস্থিতি এবং তাদের সন্দেহজনক কার্যক্রম নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করেছে। যে দলগুলো সশস্ত্র অবস্থায় সক্রিয় রয়েছে সেগুলো হলো-আরসা, আরএসও, ইসলামি মাহাজ, মাস্টার মুন্না দল, চাকমা ডাকাত দল, নবী হোসেন ডাকাত দল, পুতিয়া ডাকাত দল, জাকির ডাকাত দল, সালমান শাহ ডাকাত দল, খালেক ডাকাত দল ও জাবু ডাকাত দল। এর মধ্যে উখিয়া, বালুখালী, পালংখালী এবং হোয়াইক্যং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র অবস্থায় সক্রিয় রয়েছে আরসা। আরএসও আছে উখিয়া এবং পালংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ইসলামী মাহাজ আছে হোয়াইক্যং ক্যাম্পে। উখিয়া এবং পালংখালিতে রয়েছে আরও একটি দুর্বৃত্ত দল মাস্টার মুন্না দল। অন্যদিকে নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর রয়েছে চাকমা ডাকাত দল, নবী হোসেন ডাকাত দল, পুতিয়া ডাকাত দল, জাকির ডাকাত দল, সালমান শাহ ডাকাত দল, খালেক ডাকাত দল। আর জাবু ডাকাত দলের তৎপরতা রয়েছে হোয়াইক্যং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সরকারের একটি বিশেষ বাহিনীর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ে দেয়া বিশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন
গত বুধবার সংসদ সচিবালয়ে ওই কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটির সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান, মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ এবং মো. নাসির উদ্দিন অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। 

সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে, কমিটির সভায় বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের (এফডিএমএন) সার্বিক নিরাপত্তা, ব্যবস্থাপনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে আবাসন সম্পর্কিত একটি ডকুমেন্টারি বাংলাদেশ নৌবাহিনী কর্তৃক প্রদর্শন করা হয়। সংসদীয় কমিটিকে দেয়া বিশেষ প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলা হয়েছে- সক্রিয় সশস্ত্র দুর্বৃত্ত দলগুলোর মধ্যে আরসার উপস্থিতি এবং তাদের সন্দেহজনক কার্যক্রম নিরাপত্তার ঝূঁকি তৈরি করেছে। এতে আরও বলা হয়েছে- তুমব্রু কোনাপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অবস্থান জিরো লাইনে হওয়ায় নিয়মিত টহল কার্যক্রম পরিচালনা এবং সার্বিক পরিস্থিতি নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে উক্ত ক্যাম্পটি আরসার সাংগঠনিক কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তুমব্রু  কোনাপাড়া ক্যাম্পে আরসা সন্ত্রাসীদের অবাধ বিচরণকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জন্য ভবিষ্যৎ কৌশল প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এফডিএমএন ক্যাম্পসমূহের বেশির ভাগ ক্যাম্পের উপর আরসার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বলে প্রতীয়মান। পক্ষান্তরে কিছু কিছু ক্যাম্পে নবী হোসেন দলের আধিপত্য স্থাপিত হয়েছে। ফলে এফডিএমএন ক্যাম্পসমূহের মধ্যে মাদক, চাঁদাবাজি, মানব পাচার ইত্যাদির উপর আধিপত্যকেন্দ্রিক সংঘর্ষ প্রায়শই সংঘটিত হচ্ছে এবং ব্যক্তিভিত্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এতে বলা হয়েছে- আরসা এবং নবী হোসেন দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এফডিএমএন ক্যাম্পগুলোর সার্বিক নিরাপত্তায় এপিবিএন নিয়োজিত রয়েছে বিধায় পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা শাখার তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আরসা ও নবী হোসেন দলের নেতৃস্থানীয়দের গ্রেপ্তার ও তাদের ঘাঁটিসমূহ উৎখাত করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে প্রতীয়মান। এতে বলা হয়েছে- বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও উন্নতি হতে পারে। বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বর্তমানে সেনাবাহিনী কর্তৃক শুধুমাত্র এফডিএমএন ক্যাম্পের চতুর্দিকে টহল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। নিরাপত্তা পরিস্থিতির উপর এই কার্যক্রমের দৃশ্যমান কোনো প্রতিফলন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এ কারণে কিউআরএফ সমূহ সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন করানো যেতে পারে। উল্লেখ্য, বিশেষ প্রয়োজনে রামু সেনানিবাস হতে ত্রিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে কিউআরএফ সমূহ ক্যাম্প এলাকায় যেতে সক্ষম। বিশেষ প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্বাস্থ্য সংকট, জন্মহার ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। স্বাস্থ্য সংকট প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- এফডিএমএন বিভিন্ন মহামারি যেমন এইচআইভি/এইডস, হেপাটাইটিস সি, ডিপথেরিয়া ইত্যাদির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। 

এখন পর্যন্ত কক্সবাজার এলাকায় ৭১০ জন মানুষ এইচআইভি পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৬১২ জনই রোহিঙ্গা। ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত মোট ৬১ জন রোহিঙ্গা এইচআইভিতে মৃত্যুবরণ করে। এতে বলা হয়েছে- বর্তমানে ৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নারী কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে দেহ ব্যবসায় সক্রিয় রয়েছে বলে জানা যায়। পরামর্শ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- কক্সবাজার এলাকা এবং দেশে এইডস ছড়ানোর ঝুঁকির জন্য জাতীয় পর্যায়ে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। জন্মহার নিয়ে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন প্রায় ৯৫ জন শিশুর জন্ম হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২-১৩ লক্ষ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। জন্মহার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। অগ্নিকাণ্ডের তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ১লা জানুয়ারি ২০২১ থেকে ১লা ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত মোট ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত অগ্নিকা-, ৬০টি নাশকতার ঘটনা এবং অজ্ঞাত কারণে ৬৩টি ঘটনা ঘটেছে। ভবিষ্যতে আগুনের ঝুঁকি মোকাবিলা করার লক্ষ্যে এফডিএমএন ক্যাম্পের জন্য ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ফায়ার ইউনিট স্থাপন করা যেতে পারে।

 বিশেষ প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে ২০২১ ও ২০২২ সালের অপরাধের তুলনা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- ২০২১ সালে চুরির ঘটনা ঘটেছে ৭৭টি, ২০২২ সালে ৭৫টি। ২০২১ সালে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে ৫১টি আর ২০২২ সালে হয়েছে ১৮টি। ২০২১ সালে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১৭৩টি, ২০২২ সালে হয়েছে ৮৬টি। ২০২১ সালে আন্তঃকোন্দল হয়েছে ১১টি আর ২০২২ সালে ১টি। মাদকের ঘটনা ২০২১ সালে ঘটেছে ২৬৮টি অন্যদিকে ২০২২ সালে হয়েছে ২৪৯টি। বিশেষ প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ২২টি হত্যাকা- ঘটেছে আর ২০২২ সালে সেটা হয়েছে ৪২টি। এ ছাড়া ২০২১ সালে অন্যান্য অপরাধ হয়েছে ৫৬৭টি আর ২০২২ সালে হয়েছে ৫৫৩টি।  

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status