মত-মতান্তর
প্রশ্নের মুখে ‘১৫তম সংশোধনীর সাংবিধানিকতা’
ড. বদিউল আলম মজুমদার
(৯ মাস আগে) ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১১:২৯ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:২০ পূর্বাহ্ন

১৯৯৬ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার (NCG) গঠনের অনুমতি দিয়ে সংবিধানের ১৩ তম সংশোধনী পাস করে। সংশোধনীটি একটি ‘রাজনৈতিক সমঝোতার’ দিকে ইঙ্গিত করে। কারণ তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন দলগুলোর জোট এই ধরনের ব্যবস্থার দাবি করেছিল এবং বিএনপি অনেক প্রতিরোধের পর সেই দাবি মেনে নিয়েছিল। এটি কেবল শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের অনুমতি দেয়নি, পাশাপাশি বড় রাজনৈতিক দলগুলোকেও সমান সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু ২০১১ সালে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ পদ্ধতিতে ১৫ তম সংশোধনীর একতরফা পাস রাজনৈতিক মীমাংসাকে ধ্বংস করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের হাতে সাংবিধানিক অস্ত্র তুলে দিয়েছিলো । এটি শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে ১৪ তম সংশোধনী পাস করার মাধ্যমে। তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়েছিল এটি নিশ্চিত করে যে, একজন বিশেষ সাবেক প্রধান বিচারপতি নবম সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হবেন। আরও একটি ধাক্কা আসে ২০১১ সালের ১০ই মে। রাজনৈতিক মীমাংসার পথে ধাক্কাটি আসে আপিল বিভাগের একটি ‘সংক্ষিপ্ত আদেশের’ মাধ্যমে। ২০১১ সালের ১০ই মে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১০ তম এবং ১১ তম সংসদ নির্বাচনের পরে ১৩ তম সংশোধনী ‘সম্ভাব্যভাবে’ বাতিল ঘোষণা করেন, যদিও হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ এর আগে সংশোধনীটিকে সাংবিধানিক বলে মনে করেছিল।
উল্লেখ্য, সংবিধান সংশোধনের জন্য ২০১০ সালের ২১ জুলাই ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়, যার মধ্যে ১২ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সদস্য। তিন মাসের মেয়াদে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বহাল রেখে সংবিধান সংশোধনের জন্য সাবেক রাষ্ট্রপতি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তিন সাবেক প্রধান বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতা, সম্পাদক এবং সুশীল সমাজের সদস্যসহ ১০৪ জন বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে আলোচনার পর ২০১১ সালের ২৯ মার্চ সর্বসম্মতিক্রমে সুপারিশ করে। পরের দিন কমিটি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে, যার ফলে কমিটির সুপারিশে পরিবর্তন আসে এবং এই ব্যবস্থা বাতিলের জন্য সংবিধান সংশোধনের পরামর্শ দেয়া হয়।
৩১ মে ২০১১, প্রধানমন্ত্রী একটি সংবাদ সম্মেলন করেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন- আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে এই মর্মে যে, এই ব্যবস্থার অধীনে পরবর্তী দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে (প্রথম আলো, ২০১১ সালের ১ জুন), যা সত্য ছিল না।
এইভাবে ১৫ সদস্যের সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সুপারিশকে অমান্য করে শুধু ১৫ তম সংশোধনী পাসই হয় না, বরং আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ এবং ১৪ মাস পরে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে একটি গুরুতর ভুল উপস্থাপনের মাধ্যমে এটি পাস করা হয়। এটি ছিল স্বার্থসিদ্ধির জন্য নেয়া একটি সিদ্ধান্ত, যার ফলে পরবর্তী নির্বাচন একই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। গবেষক আদিবা আজিজ খানের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ‘বিরোধী, সুশীল সমাজ এবং ভোটারদের ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সুপার সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ আদালতের দেয়া নির্দেশনাকে উপেক্ষা করেছে যে NCG আরও দুটি জাতীয় নির্বাচনের জন্য বহাল থাকবে।’
পঞ্চদশ সংশোধনীর সাংবিধানিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাদের সম্মতি ছাড়া এটি সংশোধন করা উচিত নয়। যদিও দেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে এটি ছিল না, পঞ্চম সংশোধনী সংবিধানে গণভোটের বিধান অন্তর্ভুক্ত করেছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে একটি সমঝোতার ভিত্তিতে ১২ তম সংশোধনীটি ১৯৯১ সালে পাস হয়েছিল। প্রস্তাবনা এবং আরও কয়েকটি অনুচ্ছেদের সংশোধনের মাধ্যমে গণভোটের বিধান সংশোধন করা হয় । যদিও আপিল বিভাগের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী অসাংবিধানিক বলে মনে করা হয়, তবে গণভোটের বিধানটি রয়ে গেছে কারণ এটি ১২ তম সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, ১৫ তম সংশোধনী বৈধ বা সাংবিধানিক ছিল না, কারণ এটি পাসের আগে কোনো গণভোট অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৫তম সংশোধনীটি পাস হওয়ার আগে কোনও গুরুতর আলোচনা হয়নি। যদিও বিএনপিকে বিশেষ সংসদীয় কমিটির জন্য একটি নাম প্রস্তাব করতে বলা হয়েছিল, তারা তা করতে অস্বীকার করে এবং সংশোধনী পাসের সময়ও তারা অনুপস্থিত ছিল। অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীতে প্রধান বিরোধীদের সমর্থন ছিল না। উপরন্তু ১৫তম সংশোধনী সংবিধানের প্রায় এক তৃতীয়াংশকে ‘মৌলিক বিধান’ হিসাবে উপনীত করে, যার অর্থ এটিকে আর সংশোধন করা যাবে না। এটা স্পষ্টভাবে মৌলিক কাঠামোর সাংবিধানিক ক্ষমতাকে লঙ্ঘন করেছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘কোন সংসদ উত্তরসূরিকে আবদ্ধ করতে পারে না (বাংলাদেশের সংবিধানিক আইন, ৩য় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩১), আর তাই ১৫তম সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলা যায়।’
আপিল বিভাগের রায়ও অসাংবিধানিক। মাহমুদুল ইসলাম যুক্তি দিয়েছিলেন, 'আগামী দুটি সংসদীয় নির্বাচনের জন্য 'এনসিজি' ব্যবস্থা রাইডার্স ক্লজ প্রদান করে। যার অর্থ আপিল বিভাগ সংবিধানকে সামনে রেখে নির্ধারিত সংসদের কার্যাবলীতে হস্তক্ষেপ করে বিচার বিভাগীয় আইন প্রণয়ন করে এবং এর ফলে সুপ্রতিষ্ঠিত আইনশাস্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আইনের শাসন এবং ক্ষমতা পৃথকীকরণের পরিপন্থী হিসেবে কাজ করেছে 'এনসিজি' ব্যবস্থা। আপিল বিভাগও রাজনৈতিক বিষয়ে মাথা গলিয়ে রাজনীতির নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। এছাড়াও, বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংঘটিত করার সংসদীয় অনুমোদনের শর্ত যুক্ত করে তার চূড়ান্ত রায়কে পরিবর্তন করেছেন, যা ‘আদালতে জালিয়াতি’ এবং পেশাদার আচরণবিধি লঙ্ঘনের সমান। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তির জেরে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে দুটি ব্যর্থ নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেছিলো বাংলাদেশ। আরেকটি ব্যর্থ নির্বাচন দেশের মানুষের জন্য গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এক কথায় বলতে গেলে, নতুন রাজনৈতিক মীমাংসা ছাড়া একটি বিশ্বাসযোগ্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংঘটিত হওয়া প্রায় অসম্ভব।
মন্তব্য করুন
মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন
মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]