ঢাকা, ১৯ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

ফিরে দেখাঃ যেভাবে ১৯৭২ সালে মুক্ত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন মিরপুর

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অবঃ)

(১ বছর আগে) ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার, ৩:৫৩ অপরাহ্ন

mzamin

উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মেট্রো রেলে আগারগাঁও এর পথে চলেছি। উত্তরার বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তর, শস্যক্ষেত, লেক, সুপরিকল্পিত মিরপুর ডিওএইচএস, সুবিন্যাস্ত মিরপুর সেনানিবাস  (মিরপুর সামরিক শিক্ষা পল্লী)হয়ে মিরপুরের বুক চিরে চলছে সিলভার রঙের বাংলাদেশের প্রথম মেট্রো রেল। মিরপুর ১২ ও ১১ নম্বর সেকশন অতিক্রম কালে মনে পড়লো ৫১ বছর পূর্বে (৩০ শে জানুয়ারি ১৯৭২) এখানে ঘটে যাওয়া বিভীষিকাময় এক ঘটনার কথা। মিরপুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন। বিজয়ের প্রায় দেড় মাস পর ১৯৭২ এর ৩১ জানুয়ারি মুক্ত হয়েছিল এই অবরুদ্ধ উপশহর। অস্ত্রধারী সহস্র বিহারী, অবাঙালীও দলছুট পাকিস্তানী বাহিনীর সদস্যদের এই শক্ত ঘাঁটি মুক্ত করতেপ্রাণ বিসর্জণ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর শতাধিক সদস্য।  মিরপুর মুক্ত হয়েছিল অপ্রত্যাশিত তীব্র এক যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে । লে: সেলিম, সুবেদার মোমিন, সিপাহী হানিফ সরকার, এডিশনাল এসপি লোদী ও সার্কেল ইনসপেক্টর ওয়াহিদ প্রমুখ ছিলেন আমাদের সেইসব শহীদের অন্যতম। বরেন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা-সাংবাদিক-সাহিত্যিক জহির রায়হান মিরপুরে এসে এখানেই প্রাণ হারান, শহীদ হন। ৩১ শে জানুয়ারি “মিরপুর মুক্তদিবস”-মুক্তিযুদ্ধের এক স্বতন্ত্র অধ্যায়।

মডেল টাউন থেকে মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন
পাকিস্তান সরকার হাউজিং সেটেলমেন্ট দপ্তরের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে আসা বিহারী ও উর্দুভাষী মুসলমানদের (মোহাজের) স্থায়ীভাবে পূনর্বাসনের জন্য মডেল টাউনের আদলে মিরপুর ও মোহাম্মদপুরেআবাসনের ব্যবস্থা করে।ফলে
মিরপুর ও মোহাম্মদপুর ছিল মূলত বিহারী ও উর্দূভাষী (সাধারণভাবে বিহারী বলে পরিচিত)  অধ্যুষিতএলাকা।

বিজ্ঞাপন
বেশীরভাগ শ্রমিক শ্রেণী বিশেষ করে রেলওয়ে, টিএন্ডটি, কলকারখানার শ্রমিক এবং মাংস ব্যবসায়ীসহ ছোট ব্যবসায়ীরা মিরপুরে থাকতো। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে অনেক বিহারী বা উর্দূভাষীরা পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগীরূপে বাঙালিদের উপর ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিদের প্রতিশোধ নেওযার সম্ভাবনা ছিল। ১৬ ডিসেম্বর থেকেই ভারতীয় বাহিনী (১০ বিহার রেজিমেন্ট) মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় পাহারা বসায়, যাতে বিহারিদের জানমাল রক্ষা পায়। ভারতীয় বাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শুরু হলে বিহারীদের পাহারা দিয়ে রাখার দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপর বর্তায়।

ঢাকার বাসিন্দা তখন বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হলেও শহরের উপকন্ঠ মিরপুর তখনো “স্বাধীন” হয়নি। বিষয়টি তখন এরকম ছিল যে, মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই সেটিকে স্বাধীন বাংলাদেশে ‘এক টুকরো পাকিস্তান’ হিসেবে বর্ণনা করেন। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষযুদ্ধের সময় বেশ কয়েক হাজার বিহারীকে অস্ত্র প্রশিক্ষন দিয়ে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপক্যাফ) গঠন করা হয়।১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পনের পর ইপক্যাফেরঅনেক সদস্য, দলছুট পাকিস্তানী সৈন্য, রাজাকার ও বিহারী মিলিশিয়া অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিরপুরে আশ্রয় নেয়। এছাড়া ও পাকিস্তানী বাহিনী যখন পিছু হটছিল তখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসকারী বিহারীরা মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের নিজেদের আত্মরক্ষার প্রয়াসও ছিল। ফলে মিরপুরে সশস্ত্র অবাঙ্গালীদের শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে ওঠে।

অবরুদ্ধ মিরপুর তখন যে রকম 
বাংলাদেশের সর্বত্র পাকিস্তানী বাহিনী অস্ত্র সমর্পন করলেও মিরপুরের বিহারীরা তখনও অস্ত্র সমর্পন করেনি। মিরপুর তখনও অবরুদ্ব।এদিকে ডিসেম্বরের ৩য় সপ্তাহ থেকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলো ধীরে ধীরে মিরপুরের কিছু কিছু অংশ বিহারীদের থেকে দখলমুক্ত করতে থাকে। এর ফলে বিহারীদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছিল। এর ফলে বিহারীরা মিরপুর ১১ ও ১২ নম্বর এলাকায় জড়ো হতে শুরু করে। বিভিন্নভাবে বারবার আহবানের পরও আত্মগোপনকারী সশস্ত্র বিহারীরা আত্মসমর্পন করতে অস্বীকার করে। বিহারীদের উপর প্রতিশোধমূলক নিপীড়নের কিছু ঘটনাও ঘটে। মিরপুরে এই অরাজক অবস্থার অবসানের লক্ষ্যে ডাঃ মোশাররফ হোসেনের (মোহাম্মদপুর-মিরপুরের এমপি) নেতৃত্বে মিরপুরের সিনিয়র আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন এবং শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার অনুরোধ করেন। এর পরিপেক্ষিতেই সরকার সেনাবাহিনী ও পুলিশের মাধ্যমে মিরপুরে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের নির্দেশ দেন।

বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি বা কমান্ডার ইন চীফ জেনারেল এমএজি ওসমানীর অস্থায়ী সদরদপ্তর ছিল ঢাকার ২৭ মিন্টো রোডে (বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তর), লাল রঙের পুরনো বিল্ডিংয়ের। তখনও  পৃথকভাবে সেনা নৌ ও বিমান বাহিনী গড়ে ওঠেনি। ঢাকা সেনানিবাসে তখন ভারতীয় বাহিনী অবস্থান করছিল। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় প্রবেশকারী নিয়মিত বাহিনীর প্রথম ব্যাটালিয়ন ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল রমনা রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে)। এর অধিনায়ক বা কমান্ডিং অফিসার (সিও) ছিলেন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম, (পরে মেজর জেনারেল)। উল্লেখ্য, ২য় বেঙ্গল ছিল এস ফোর্সের (যা ৪৬ পদাতিক ব্রিগেড রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় ছিল) নিয়ন্ত্রনাধীন যার অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্ণেল কে এম শফিউল্লাহ (পরে মেজর জেনারেল, বীর উত্তম ও প্রথম সেনাবাহিনী প্রধান)। 
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়ে জেনারেল ওসমানী ২য় বেঙ্গলের অধিনায়ককে এক কোম্পানী সৈন্য মিরপুর পাঠাতে বলেন। মেজর জেনারেল মইন তার “এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্যঃ স্বাধীনতার প্রথম দশক” বইতে এই বিষয়ে বর্ণনা করেন “ওসমানী আমাকে বলেন, বিহারী, রাজাকার ও তাদের সহযোগীদের গ্রেফ্তারের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী মিরপুর ১২ নং সেকশনে যাবে। পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগীদের একটা লিষ্টও তারা তৈরী করেছে। তিনি পুলিশকে সৈন্য দিয়ে সহায়তা করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেন”। জেনারেল ওসমানীর আদেশ পেয়ে, তৎকালীন ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মোরশেদ খান, বীর বিক্রম (পরে মেজর জেনারেল) এর নেতৃত্বাধীন ২য় বেঙ্গলের ডি কোম্পানীকে ২৯ জানুয়ারী ১৯৭২ তারিখে মিরপুর পাঠানো হয়। এদিকে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম (পরে মেজর, এমপি, বিএনপির মন্ত্রি) এর নেতৃত্বে ১ ইষ্ট বেঙ্গল এর একটি কোম্পানীকে বিহারী অধ্যুষিত মোহাম্মদপুরে পাঠানো হয় ।

অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিকল্পনা 
২৯ জানুয়ারী বিকেলে ক্যাপটেন হেলাল মোর্শেদের নেতৃত্বে ডি কোম্পানীর প্রায় ৭৫ জন সৈন্য মিরপুরের ২নং সেকশনে পৌছায় ও ভারতের ১০ বিহার রেজিমেন্ট থেকে দায়িত্বভার গ্রহন করে। ভারতীয় মেজর বাংলাদেশের ক্যাঃ মোর্শেদকে বলেন “এভরিথিং ইজ ফাইন হিয়ার এন্ড উইশ ইউ গুড লাক” (এখানে সব কিছু ঠিক আছে এবং তোমার জন্য শুভেচ্ছা)। আশ্চর্যজনকভাবে উক্ত মেজর বিহারীদের অস্ত্র সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য দিনেনি। এদিকে পুলিশ ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকেও সুনির্দিষ্টভাবে বিহারীদের অস্ত্র গোলাবারুদ সম্পর্কে তেমন উল্লেখযোগ্য তথ্য ক্যাপ্টেন মোর্শেদ পাননি। এই তথ্য ঘাটতিই পরে সবার বিপর্যয় ডেকে আনে। যাই হোক, ৩০ জানুয়ারী সকালে মিরপুর ২নং সেকশনে ডি কোম্পানীর সদরদপ্তরে পুলিশের এডিশনাল এসপি জিয়াউল হক খান লোদীর নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আসেন এবং ঐদিনের অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের কার্যপ্রনালী নিয়ে আলোচনা করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয় যে, সেনাবাহিনী এলাকার নিরাপত্তা বিধান করবে এবং পুলিশ সদস্যগন বিহারীদের থেকে অস্ত্র উদ্ধার করবে ও অপরাধীদের গ্রেফ্তার করবে।সেদিন মিরপুরে কারফিউ জারী করা হয়। এখানে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ছিল মূলত ইন এইড অফ সিভিল পাওয়ার বা অসামরিক প্রশাসনের সাহায্যে অপারেশন এর মতো।
পরিকল্পনা মতো সকাল ১০টায় পুলিশ বাহিনীর প্রায় ১০০ জন ও সেনাবাহিনীর প্রায় ৭৫ জন সদস্য অস্ত্র উদ্ধারের জন্য ১১ ও ১২ নং সেকশন এলাকায় পৌছায় (বর্তমান পল্লবী থানার অধীনে)। এরই মধ্যে ২য় বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর মইন একটি জীপে করে সেকেন্ড লেফটেনেন্ট সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসানকে ১২নং সেকশন এলাকায় পৌঁছে দেন। উল্লেখ্য লেঃ সেলিম তখন প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর নিরাপত্তা অফিসার হিসেবে বঙ্গভবনে কর্মরত ছিলেন। প্রায় একই সময় ১২ নং সেকশনে এসে পৌঁছান বরেন্য  চলচ্চিত্র নির্মাতা-সাহিত্যিক জহির রায়হান। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন তার বড় ভাই বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক-সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারের সন্ধানে।জহির রায়হানের মিরপুর আসা নিয়ে ২য় বেঙ্গলের সেনা কর্মকর্তা তৎকালীন লেঃ সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক (পরে মেজর জেনারেল, কল্যান পার্টির চেয়ারম্যান)তাঁর বইতে লিখেন” ঘটনার দিন অতি ভোরে আমি, নিজাম, জহির রায়হান....এক সঙ্গে গাড়িতে করে মিরপুর ..... যাই। (সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর)।উদ্ধার অভিযানের বড় একটা অংশ তখন ১২ নং সেকশনের ডি ব্লকের পানির ট্যাংকির কাছে অবস্থান করছিল।

অস্ত্র উদ্ধার অপারেশন থেকে ভয়াবহ যে যুদ্ধ

১২ নম্বর এলাকায় পুলিশ ও সেনা সদস্যগন যখন অস্ত্র উদ্ধার  কার্যক্রম শুরু করেন। ঠিক এর কিছুক্ষন পর আশ্চর্যজনক ,অপ্রত্যাশিত ও অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে। ঢং ঢং করে কয়েকটা পাগলা ঘন্টি বেজে ওঠে ও হইহই আওয়াজ হয়। চতুর্দিকের বিভিন্ন বাড়ি ঘর থেকে অতর্কিতে একযোগে ক্যাঃ মোর্শেদের নেতৃত্বাধীন সৈন্য ও পুলিশের ওপর বিহারীরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি দিয়ে প্রচন্ড আক্রমন চালায়। লুকিয়ে থাকা বিহারীদের এই অতর্কিত আক্রমনের জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ফলে চারদিকের প্রচন্ড আক্রমনের মাঝে পড়ে পুলিশ ও সৈন্যরা ব্যাপকভাবে হতাহত হয়। তারা পাল্টা আক্রমনের তেমন কোন সুযোগই পায়নি। এটি ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত আক্রমন। কোম্পানী কমান্ডার ক্যাঃ হেলাল মোর্শেদ ও লেঃ সেলিম আহত হন। আহত হয়েও তারা কয়েকজন সৈনিক নিয়ে দল গঠন করে পাল্টা আক্রমনের আপ্রান চেষ্টা করেন্। প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার আবদুল মোমিন প্রচন্ড ফায়ারিং এর মধ্যেও সৈনিকদের জড়ো করে প্রতিরোধের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষনপর তিনিও প্রান হারাণ।বিহারীদের মধ্যে কয়েক হাজার প্রশিক্ষিত অস্ত্রধারী থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। ১২ নম্বর সেকশনের প্রতিটি লেনের বাড়ির জানালা ও ছাদে বিহারী অস্ত্রধারীরা পজিশন নিয়ে টার্গেট করে বসেছিল। এদিকে ১১ নং সেকশনে অবস্থানকারী সৈন্যদের উপরও আক্রমন আসে। তবে তারা সে আক্রমন প্রতিহত করে।

আক্রমনের খরব শুনে ২য় বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর মইন, বি কোম্পানীকে নিয়ে ১২ নং সেকশনের উল্টাদিকে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কাছের অবস্থান নেন। ৬নং সেকশনে দুপুরের দিকে এস ফোর্স কমান্ডার কর্নেল শফিউল্লাহর গাড়িও বিহারীদের গুলিতে আক্রান্ত হয়।
বিকেলে ২য় বেঙ্গলের সৈনিকগন ভারী অস্ত্র নিয়ে ১২ নং সেকশনে আক্রমন চালায়। রাতে মর্টার নিক্ষেপ করা হয়। তবে তারা ১২ নং সেকশনেযেখানে মূল যুদ্ধ চলেছিল সেখানে পৌছাতে পারে নাই।সেখানে বিহারীরা প্রচন্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলে।পরদিন অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারী রমনা রেসকোর্স থেকে সমগ্র ব্যাটালিয়ানকে মিরপুর যুদ্ধে নিয়োজিত করা হয়। আহত ক্যাপ্টেন মোর্শেদ তার ক্ষুদ্র দল নিয়ে কালাপানির বিল অতিক্রম করে সন্ধ্যার দিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দিকে (বালুরঘাট) চলে আসতে সক্ষম হন।
মোর্শেদ ও সেলিম এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে, রাতে মিরপুর যুদ্ধের দায়িত্বকমান্ডিং অফিসার মেজর মইন গ্রহন করেন। ৩১ জানুয়ারীতে ১২ নং সেকশনে সকাল ১০টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলে। সৈন্যদের চারদিকে সতর্কতার সঙ্গে মোতায়েনের পর ২য় বেঙ্গলের সেনা কর্মকর্তাগন ১২ নং সেকশনে আসেন। অধিনায়কের সঙ্গে দুইজন ভারতীয় সিনিয়র সেনাকর্মকর্তাও যান। সেখানে বিহারীদের বেশ কিছু মৃতদেহ পাওয়া যায়। ঐদিন সেই এলাকায় কোন পুরুষ ছিল না। তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। দুপুরে বেশকিছু অস্ত্রধারী বিহারী ও অবাঙ্গালী সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে। এভাবে অবরুদ্ধ মিরপুর ওইদিন সেনাবাহিনী তথা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে।

মিরপুর অভিযানের দ্বিতীয় পর্যায়
৩১ জানুয়ারী সকালে উর্ধ্বতন সেনাকতৃপক্ষ মিরপুরের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে উপলব্ধি করেন যে, পুরো মিরপুর তথা ১নং সেকশন থেকে পর্যায়ক্রমে ১২ নং সেকশন পর্যন্ত অস্ত্রমুক্ত করতে ও অস্ত্রধারী, অপরাধীদের গ্রেফতার করতে হলে আরো সৈন্য প্রয়োজন। এ পরিপ্রেক্ষিতে জয়দেবপুর থেকে মেজর এইচ এম আব্দুল  গাফফার, বীর উত্তম (পরে লেঃ কর্নেল, এমপি, জাতীয় পার্টির মন্ত্রী) এর নেতৃত্বে ৪ ইষ্ট বেংগল ও কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে মেজর মোহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর প্রতীক (পরে মেজর জেনারেল) এর নেতৃত্বে ৯ ইষ্ট বেঙ্গল মিরপুরে মোতায়েন করা হয়। তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়ান প্রায় এক মাসের অভিযানের পর মিরপুরের চলমান অরাজক অবস্থার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে সেনাবাহিনী। এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাগন  বিশেষতঃ বাবর গ্রুপ, মামা গ্রুপ ,হানিফগ্রুপ ও তৈয়বুর গ্রুপ এর সাহসী মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
৩০ জানুয়ারীর অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানটি এক পর্যায়ে রক্তাক্ত যুদ্ধে পরিনত হয়। এই যুদ্ধে ২য় বেংগলের (সেনাবাহিনীর)সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সেলিম, সুবেদার আবদুল মোমিন ও ৪০ জন অন্যান্য পদবীর সৈনিক অর্থ্যৎ মোট ৪২ জন সেনা সদস্য শহীদ হন। বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী মিরপুরে পুলিশ বাহিনীর ৫৩ জন সদস্য শহীদ হয়েছিলেন। তবে অন্য একটি সুত্র মতে এর সংখ্যা ৮২ জন। শহীদ হন দক্ষ পুলিশকর্মকর্তা এডিশনাল এসপি জিয়াউল হক খান লোদি ও সার্কেল ইনসপেকটর এসএমএ ওয়াহিদ। মেজর জেনারেল মোর্শেদ পরবর্তীকালে এ ঘটনার সঙ্গে ‘ব্ল্যাক হক ডাউন’ (সোমালিয়ায় আমেরিকানআর্মির অভিযানের উপর নির্মিত  ফিল্ম) এর ঘটনারতুলনা করেছিলেন। এখানে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন। দুঃখজনকভাবে কোন শহীদের লাশ পাওয়া যায়নি।তাদের কারও মৃতদেহ কিংবা অস্ত্র বা অন্য কোন চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বিহারীরা রাতেই সকল লাশ সরিয়ে ফেলে। তবে ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে একটি ঝিলের পাড়ে পাওয়া একটি মৃহদেহের ক্ষুদ্র অবশিষ্টায়ংশকে লেঃ সেলিমের মৃতদেহ বলে সনাক্ত করা হয়। পরবর্তীতে এই শহীদের দেহাবশেষ বনানী সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এছাড়াও উভয় বাহিনীর জীবিত সদস্যদের প্রায় অর্ধেকই আহত হয়েছিলেন। এতোই ছিল এই যুদ্ধের ব্যাপ্তি ও কঠিনতা।

মিরপুর যুদ্ধ পূন:পাঠের প্রাসঙ্গিকতা
৫১ বছর পর এই আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা কি? ৩০ জানুয়ারীতে মিরপুরে সংঘটিত বিপর্যয়মূলক ঘটনাটি সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর শোকের দিন। সামরিক দৃষ্টিকোন থেকে শিক্ষারও দিন। এটি স্মরন করিয়ে দেয়, এই ধরনের জটিল অভিযানের পূর্বে ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ (তথ্য সংগ্রহ), সতকর্তা,প্রয়োজনীয় রিকনিসনস, এলাকা পরিচিতি,সুষ্ঠূ পরিকল্পনা, সময় নিয়ে প্রস্তুতি (তাড়াহুড়া না করা) কত গুরুত্বপূর্ন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটিই ছিল সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের সময় শহরাঞ্চলে সংঘটিত একমাত্র  ক্ল্যাসিক“বসতি এলাকায় যুদ্ধ“ বা ফাইটিং ইন বিল্টআপ এরিয়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল মূলত গ্রামাঞ্চলে। তবে প্রতিরোধের প্রাথমিক পর্যায়ে মেজর রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম (পরে এমপি, আওয়ামী লীগ এর মন্ত্রী) এর নেতৃত্বে ইপিআর চট্টগ্রাম নগরীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বসতি এলাকায় কয়েকটি খন্ড যুদ্ধেজড়িয়ে পড়েছিল, যা ছিল বীরত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, বসতি এলাকায় যুদ্ধ হলো বৃহত্তর আরবান ওয়ারফেয়ারের (নগরাঞ্চলে যুদ্ধ) অর্ন্তভূক্ত। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী কোন দেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে বসতি এলাকা যুদ্ধ হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর তাই, সেনাবাহিনীর জন্য মিরপুরের যুদ্ধ ‘বসতি এলাকা যুদ্ধের’ কেস ষ্টাডির অনন্য উদাহরন হতে পারে। সামরিক দৃষ্টিকোন থেকেও এই যুদ্ধের ভূল ত্রুটিগুলো থেকে  শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। শুধু এটিই নয়, গত ৫০ বছরে আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ের বড় ভূল ত্রুটি ও  ব্যার্থতাগুলো  নির্মোহভাবে চিহ্নিত ও বিশ্লেষন করে আত্মউপলদ্ধি (সোল সার্চিং) করা প্রয়োজন। এতে আমাদের আগামীর যাত্রা মসৃণ হবে।

মুক্তিযুদ্ধে ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
১৯৪৯ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারী প্রতিষ্ঠিত ২য় ইষ্ট বেংগল (জুনিয়র টাইগার্স) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ইউনিট। মুক্তিযুদ্ধে এই ইউনিটের অসাধারন, ভূমিকা রয়েছে। স্মরন করা যেতে পারে, ১৯৭১ এর ১৯ মার্চ, এই ব্যাটালিয়নের অস্ত্র জমা নেয়া কেন্দ্র করেইজয়দেবপুরে (গাজীপুর)পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের“প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ” শুরু হয়। আশ্চর্য কোইনসিডেন্স হলো, ঐ দিন মেজর মইনের নেতৃত্বে ২ ইষ্ট বেংগলের ডি কোম্পানীই (মিরপুরের যুদ্ধে নিয়োজিত) পাকিস্তানী সেনা কতৃপক্ষের বাঙালিদের উপর গুলি করার আদেশ অত্যন্ত কৌশলে বা পরোক্ষভাবে অমান্য করে হাজার হাজার সংগ্রামী জয়দেবপুরবাসীরপ্রতি সংহতি প্রকাশ করেছিল। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের শুরু ও শেষের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে । এই ব্যাটালিয়ন। উল্লেখ্য, ২য় বেংগল ছিল ১৬ ডিসেম্বর (সন্ধ্যায়) ঢাকায় প্রবেশকারী নিয়মিত বাহিনীর একমাত্র ইউনিট।মুক্তিযুদ্ধে বীরত্তর্পর্ন কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ এই ইউনিটের  ৩৩ জন সেনা সদস্য  বীরত্বসূচক খেতাবপ্রাপ্ত হন।

মিরপুর যুদ্ধের বিষয়টি প্রথম শুনি,আমাদের তৎকালীন ব্রিগ্রেড কমান্ডারব্রিগেডিয়ার হেলাল মোর্শেদের মূখ থেকেই। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারীতে ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলার এক গ্রামে, তখন আমরা (২৫ ইস্ট বেঙ্গল) শীতকালীন প্রশিক্ষনে নিয়োজিত। কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে আমরাব্যাটালিয়ন পর্যায়ে আক্রমনে যাচ্ছিলাম। শিমুল ফোটা দিনে, ব্যাটালিয়ন কমান্ড পোষ্টে বসে অধিনায়কের আদেশের ডিব্রিফিংকালে আক্রমনে কত ধরনের আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে পারে সেই প্রসঙ্গেই মিরপুরের কথা তিনি বলেছিলেন। দীর্ঘদেহী, চৌকশ ও সেই সময়ের অন্যতম  “ডেকোরেটেড” ( ইউনিফর্মে যুদ্ধ ও প্রশিক্ষনের ইনসেগনিয়া, পদকে অলংকৃত) সেনা অফিসার ব্রিগেডিয়ার হেলাল মোর্শেদের নিজের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বয়ানশুনে, আমরা তরুন কর্মকর্তাগন বিস্মিত হয়েছিলাম। তবে সেদিন ফুলপুরের রুপশী গ্রামে বসে অপরিচিত মিরপুরকে মেলাতে পারিনি। পরবর্তীকালে ২য় ইষ্ট বেঙ্গলে বিভিন্ন পদে ৬/৭ বছর চাকুরীকালে মিরপুর যুদ্বেজড়িত ও সেই সময়ে কর্মরত অনেক  সেনা সদস্য থেকে বিষয়টি বিশদভাবে জানার সুযোগ হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধে লেঃ সেলিম ও লেঃ আনিস ব্রাদার্স 
লেঃ সেলিমের ছোট ভাই, সেঃ লেঃ মোঃ আনিসুল হাসান বর্তমানে ডা: এম এ হাসান নামে পরিচিত। লেঃ সেলিম যুদ্ধের পূর্বে রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যয়নরত ছিলেন। ঢাকায় ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকেই দুই ভাইয়ের এক ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়। এরপর দুই ভাই, ৩১ শে মার্চ ভৈরবে ২য় ইস্ট বেঙ্গল এর সঙ্গে যুক্ত হন। ১৩ এপ্রিল ব্রাহ্মনবাড়িয়ার লালপুরের যুদ্ধে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে দুজন নৈপুন্য প্রদর্শন করেন। এরপর পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে শাহবাজপুর, শাহজি বাজার, নাসির নগর, তেলিয়াপাড়াসহ অসংখ্য যুদ্ধ করেন সেলিম ও হাসান ভ্রাতৃদ্বয়। জুলাই-অক্টোবরে ভারতের মূর্তিতে ট্রেনিং সম্পন্ন করে দুজন প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের সঙ্গে সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লে: হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হন। দুজনেই আবার ২য় বেঙ্গলে ফিরে আসেন। শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। এদিকে লে: সেলিম, লেঃ হেলাল মোর্শেদের সঙ্গে  ফেনির বিখ্যাত বেলোনিয়া যুদ্ধে শরিক হন। এদিকে ১ ডিসেম্বর ২য় বেঙ্গল অত্যন্ত আলোচিত আখাউড়া যুদ্ধে নিয়োজিত হলে, দুই ভাই দুই কোম্পানীতে লড়াই করেন। ৪ ডিসেম্বর আখাউড়া যুদ্ধে লে: ইবনে ফজলবদিউজ্জামান শহীদ হলে, বি কোম্পানীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন লে: সেলিম। লে: আনিস তখন এ কোম্পানীরউপাধিনায়ক।

 


রোড টু ঢাকা এডভান্স

আখাউড়া যুদ্ধ শেষে ২য় বেঙ্গল মেঘনা অতিক্রম করে নরসিংদীআসে১১ ডিসেম্বর। এরপর শুরু হলো ‘রোড টু ঢাকা এডভান্স’। ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার অদুরে মুড়াপাড়া-ডেমরা এলাকায়। ১৪ ডিসেম্বর রাতে লেঃ আনিসের নেতৃত্বে একটি টহল বাড্ডা-গুলশান এলাকার পাকিস্তানী ক্যাম্পে মর্টার ফায়ার করে। ১৬ ডিসেম্বর বিকেল প্রায় তিনটায় এই বাঙ্গালী পল্টন ডেমরা থেকে ঢাকায় যাত্রা শুরু করে। অর্ডার অব মার্চ অনেকটাই এ রকম...। প্রথমেই এ কোম্পানী, কোঃ কমান্ডার ক্যাপটেন মতিউর রহমান, বীর প্রতীক (পরে মেজর জেনারেল), তার কিছু পিছনে লেঃ আনিস। এরপর লেঃ সেলিমের বি কোম্পানী। এর পর ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার, অধিনায়ক মেজর মইন। এরপর সি ও ডি কোম্পানী ...। মেজর মইনেরপাশে হেঁটে চলছেন সিগনাল প্লাটুনের নায়েক মনির আহম্মদ। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, নায়েক মনির একজন বিহারী। তিনি জয়দেবপুর থেকে ব্যাটালিয়নের সঙ্গে বিদ্রোহ করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে সুবেদার হিসেবে অবসরগ্রহন করেন। উল্লেখ্য বাবুজান আনসারী নামে আরেকজন বিহারী সৈনিকও ব্যাটালিয়ান এর সঙ্গে বিদ্রোহ করেছিল। তবে মে মাসে যুদ্ধ তীব্রতর হলে হলে সে পালিয়ে যায়। অন্যদিকে, ক্যাপ্টেন ইকরাম উল মজিদ সেগাল (পরে মেজর) একমাত্র পাকিস্তানী সেনাঅফিসার যিনি পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে কিছুদিন বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। তিনি ২য় ইষ্ট বেঙ্গলের সঙ্গে একজন কোম্পানী কমান্ডার হিসেবেভৈরব ও নরসিংদী এলাকায় অল্প কয়েকদিন যুদ্ধ করেন। সে এক অন্য ইতিহাস।
লেঃ সেলিম যখন ঢাকার প্রবেশ দ্বার যাত্রাবাড়িতে, তখন শেষ বিকেলের কমলা আলোয় উজ্বল হয়ে ওঠে এই তরুন যোদ্ধার মুখ। আর কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা।
এর পরই দেখা হবে মায়ের সঙ্গে। ব্যাটালিয়ন যখন হাটখোলা অভিসার সিনেমা হলের সামনে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। সিনেমা হলের পোষ্টারে লেখা ‘ফল অব দ্যা রোমান এম্পায়ার’। এই ছবিটি তখন চলছে অভিসার হলে। কি অদ্ভুত সাযুজ্য ! ভাবলেন সেলিম। ব্যাটালিয়ন যখন ঢাকা ষ্টেডিয়ামে পৌঁছালো তখন রাত।

বঙ্গভবন থেকে মিরপুর রণাঙ্গন

১৯৭২ এর জানুয়ারীর ২য় সপ্তাহে লেঃ সেলিম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নিরাপত্তা অফিসারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছিলেন।
৩০ শে জানুয়ারী সকাল এগারটায় মিরপুর ১২ নং সেকশনের পানির ট্যাংকির কাছে অবস্থান ছিল লেঃ সেলিমের। অস্ত্রধারী বিহারীরা ফায়ারিং শুরু করলে প্রথমদিকেই কাঠাল গাছের পেছন থেকে ছোড়া গুলি সেলিমের ডান বুকে লাগে। মারাত্মকভাবে তিনি আহত হন।সেলিম সেখানে লুটিয়ে পড়লে তাকে একটি ঘরে নিয়ে যান হেলাল মোর্শেদ। কিছুক্ষন পর জ্ঞান ফিরে উঠে দাঁড়ান সেলিম। নিজের শার্ট দিয়ে বেঁধে ফেলেন তার বুক। অলৌকিক শক্তি যেন ভর করে তার দেহে। 
প্রথম কয়েক ঘন্টা মোর্শেদ ও সেলিম প্রায় কাছাকাছি ছিলেন। তারা চরম বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতেও৫/৬জন সৈনিক নিয়ে গ্রুপ করে প্রতিরোধ তৈরী করেছিলেন। যতদূর জানা যায়, বিকেল তিনটার দিকে সেলিম তাঁর গ্রুপ নিয়ে উত্তর দিকে অবস্থিত নুরী মসজিদে আশ্রয় নেন।

জানা যায়,দিনের শেষে কয়েকজন সৈনিক নিয়ে কালাপানির ঢালের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন লেঃ সেলিম। অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে ফ্যাকাশে ও ক্লান্ত। সবাইকে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন বিল পার হয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দিকে যেতে। নিজে পানিতে নামেননি। বুকের ক্ষত পানিতে ডুবে যাবে এই কারনে। শেষের দিকের মূহুর্তগুলো নিয়ে তাঁর ভাই লেঃ আনিস লিখেন “ক্লান্ত শরীরটা একটি গাছের আড়ালে রেখে একটা একটা করে গুলি চালাচ্ছিলেন ঘাতকের দিকে। কভার ফায়ার দিয়ে সহযোদ্ধাদের সরে যেতে সাহায্য করছিলেন তিনি। হয়ত ভাবছিলেন সাহায্য আসবে উদ্ধার করতে। সেদিন রাতে মেঘে ঢাকা চাঁদ ছিল। ঝির ঝির করে বৃষ্টি ঝরছিল। এক সময় আকাশে ফ্যাকাশে ঐ চাঁদের দিকে তাকিয়ে বীর নক্ষত্র সেলিম চির বিদায় নেন পৃথিবী থেকে”। (যুগান্তর, ৩০ জানুয়ারী, ২০২১)। এভাবেই মাত্র ২৩ বছরেই শেষ হলো একজন সাহসী বীরের জীবন।


মিরপুর যুদ্ধ নিয়ে একজন সাংবাদিকের অনুসন্ধান যাত্রা
বনানী সামরিক কবরস্থানে লেঃ সেলিমের কবরে লিখা আছে “মিরপুর মুক্তিদাতা শহীদ লেঃ সেলিম”।মিরপুরের মুক্তির জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশের যে সব সদস্য নিজের দেহের রক্ত ঝরিয়ে যুদ্ধ বিজয়ের পথ খুলে দিলেন তাদের যেন আমরা না ভুলে যাই।

মিরপুরে বিহারীদের হত্যা, নির্যাতন ও মিরপুর যুদ্ধের বিষয়টি পূনরায় ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে ১৯৯৯ সালে। তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ১৯৯৯ এর ১২ আগষ্ট থেকে বধ্যভূমি খনন, শহীদদের দেহাবশেষ ও অন্যান্য নিদর্শন উদ্ধারের কাজে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী (৪২ ইস্ট বেঙ্গল)মোতায়েন করে। এই সময়ে ভোরের কাগজের তরুন মেধাবী অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক মিরপুর রণাঙ্গনের ইতিহাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেন।

তাঁর গবেষনার অন্যতম লক্ষ্য ছিল জহির রায়হানের অন্তর্ধান রহস্য অনুসন্ধান। ভোরের কাগজ পত্রিকায় জুলফিকার আলী মানিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে জানাযায় কিভাবে মিরপুরের ১২ নং সেকশনের বিহারীদের হাতে শহীদ হয়েছিলেন জহির রায়হান। ভোরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর ভিত্তিতে পরবর্তীতে তিনি “মুক্তিযুদ্ধের” শেষ রনাঙ্গন মিরপুরঃ জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্যভেদ” শীর্ষক বই প্রকাশ করেন (২০০২)। ১৯৯৯ সালে জহির রায়হানের পুত্র অনল রায়হান তার প্রিয় বাবার সন্ধানে দিনের পর দিন মিরপুর চষে বেড়িয়েছিলেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে অনল রায়হান “সাপ্তাহিক ২০০০” এ এক আবেগঘন প্রতিবেদন লিখেছিলেন “পিতার অস্থির সন্ধানে’ নামে।

শহীদদের ভূলে যাওয়া বনাম মনে রাখা
৩০শে জানুয়ারি আনুমানিক রাত ৮ ঘটিকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিরপুরের পরিস্থিতি নিয়ে  কথা বলেছিলেন কর্নেল শফিউল্লাহ। বঙ্গবন্ধু খুব চিন্তিত হয়ে জানতে চেয়েছিলেন অপারেশনের অবস্থা। রাতে বঙ্গবন্ধূ একবার মিরপুর পুলিশ ফাঁড়িতে টেলিফোন করে সেখানে দায়িত্বরত ২য় ইষ্ট বেঙ্গলের হাবিলদারওয়াজেদ আলী বার্কির (পরে আনারারী ক্যাপ্টেন)সঙ্গে কথা বলেন। তখন বঙ্গবন্ধু ক্যাপ্টেন মোর্শেদ ও অন্যান্য সবার কথা জানতে চান। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন “ইনশাল্লাহ কোন অসুবিধা হবে না, কাল আমি চারদিকে দিয়ে সৈন্যবাহিনী আনাচ্ছি”। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লেঃ সেলিমের পিতা দেখা করলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “সেলিম আমার সন্তানের মতো। আমি তাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেবো”। উল্লেখ্য, লেঃ সেলিম ও বঙ্গবন্ধুরজেষ্ঠ্য পুত্র শহীদ লেঃ শেখ কামাল (পরে ক্যাপ্টেন) একই সঙ্গে  ভারতের মূর্তিতে প্রশিক্ষন লাভ করেন ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিনত হন।

মিরপুরের এই সব শহীদদের আমরা কিভাবে সম্মানিত করবো, কিভাবে স্মরন রাখবো? যারা দেশের জন্য মৃত্যু বরন তাদের সম্মান করলে ভবিষ্যতের বীরগন উৎসাহিত হবেন। লেঃ সেলিমসহ সব শহীদদের সম্মান জানানো ও স্মৃতি সংরক্ষন করা এখন সময়ের দাবী।

লেঃ সেলিমের অস্থির অপেক্ষায় থেকে অবশেষে ওপারে চলে গেছেন তার পিতা মাতা। শুধু রয়ে গেছেন অনুজ লেঃ আনিস, বর্তমানে তিনি ডাঃ এম এ হাসান নামে সু পরিচিত। নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন চিকিৎসা সেবায় আর মুক্তিযুদ্ধ গবেষনায়। ভাই হারানোর শোক, সহযোদ্ধা ও লক্ষ লক্ষ স্বদেশবাসী হারানোর বেদনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধগবেষনাকে তিনি ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছেন। এই কঠিন পথে কখনো হেটেছেন একাকী। যেন নির্ভীক ওয়ান ম্যান আর্মি। মানব সেবা আর মুক্তিযুদ্ধই ডাঃ এম এ হাসান ধ্যান জ্ঞান।


উর্দুভাষী বাংলাদেশী ও বাঙালির মানবিকতা
উর্দুভাষী, বিহারীদের একটা অংশ ৭১ সালে জেনোসাইডাল পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে গণহত্যা চালিয়েছে। তাদের হত্যা ও নির্যাতনের ধরণ ছিল চরম নিষ্ঠুর, বিভৎস।একাত্তরে গোটা মিরপুর যেন বধ্যভূমিতে পরিনত হয়েছিল। একই ভাবে একথাও সত্য যে, তাদের উত্তর প্রজন্ম কোন দোষ করেনি। আটকেপড়া পাকিস্তানী, বিহারী বা উর্দুভাষী বলতে আমরা যা বুঝি সরেজমিনে দেখা যায় তাঁদের বড় অংশই  বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া নারী-পুরুষ। এরা কেউ একাত্তর দেখেনি।

১৯৮২ সাল পর্যন্ত ক্যাম্পের দেড় লাখের মতো উর্দূভাষী বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে যান। তবে এরপর পাকিস্তানের অনাগ্রহে বিষয়টা বন্ধ হয়ে যায়। দেশের আদালত ক্যাম্পবাসী কয়েক জন বিহারীর পৃথক পৃথক সময়ে করা দুটি আবেদন মীমাংসা করে মত দেন- “এই ক্যাম্পবাসীরা উর্দুভাষী বাংলাদেশী” এবং “তাদের ভোটার হতে ও জাতীয় পরিচয় পত্র পেতে বাধা নেই। বাংলাদেশের মহত্তম এক ঘটনা হলো; বাংলাদেশ তার পুরনো উর্দুভাষীদের পরবর্তী প্রজন্মকে এভাবে মৌলিক অধিকার চর্চার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এটি গর্ব করার মত বিষয়।

মিরপুরসহ অন্যান্য স্থানের বিহারীদের অধিকাংশই এখন “উর্দুভাষী বাংলাদেশী”। ক্যাম্পের অমানবিক পরিবেশে কয়েক লক্ষ বিহারী বেঁচে থাকার লড়াই করছে। ”তাদের তৈরীকাবাবের মতো সুঘ্রানের মতো সুস্বাদু নয় তাদের খেটে খাওয়া জীবন।বেনারশী পল্লীর নিপুন শৈলীতে তারা অবদান রাখে নিজেদের ছেড়া পিরানে “। প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে বিহারীদের উপযুক্ত পুনর্বাসনের কথা বলেছেন। তিনি তাদেরদক্ষতা ও নিপুনতা কাজে লাগানোর কথা বলেছেন। বাংলাদেশে থাকতে ইচ্ছুক উর্দুভাষীদের অন্য বাংলাদেশীর মতো বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এটাই বাংগালীর সৌন্দর্য , সংগ্রামী বাঙালির মানবিকতা।

বাংলাদেশঃ ৫০ টি বর্নিল ফুলের সুরভিত বাগান
৫১ বছর পর পেরিয়ে আছে। অনেক জল বয়ে গেছে তুরাগের স্রোত বেয়ে, বুড়িগঙ্গায়। বাঙালি, অবাঙালি, পাহাড়ী, মুসলমান,অমুসলমান সবাইকে নিয়ে  সব বিভাজন বাদ দিয়ে এখন এগিয়ে যাবার সময়।এদেশে আমরা সবাই সমান। বাংলাদেশ হয়ে উঠুক ৫০ রকম বর্নিল ফুলের সুরভিত বাগান। আমাদের বাংলাদেশ হয়ে উঠুক অর্ন্তভুক্তিমূলক, ন্যায় ভিত্তিক, দূর্নীতিমুক্ত, মানবিক ও উদার গনতান্ত্রিক সমাজেরউজ্জল উদাহরন।

সবচেয়ে পরে মুক্ত হওয়া মিরপুর যেন উন্নয়নে সবচেয়ে পিছিয়ে না থাকে। মিরপুর যেন আর ব্রাত্য না থাকে। মেট্রো রেলের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন শুরু হোক অবহেলিত ও অনুন্নত এই জনপদে।মিরপুর মুক্ত হওয়ার এইদিনে, মিরপুর যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জণ দেয়া সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা- আমাদের সকল শহীদদের জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা। অভিবাদন। স্যালুট। পরম করুনাময় আল্লাহ তাদের  জান্নাতবাসী করুন।

লেখক: মোঃ বায়েজিদ সরোয়ার, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। গবেষক। ২য় ইস্ট বেঙ্গলের সাবেক অধিনায়ক।
[email protected]

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status