মত-মতান্তর
পর্যালোচনা: সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
(৩ বছর আগে) ২১ মে ২০২২, শনিবার, ১০:৪৪ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:৪৫ অপরাহ্ন
.jpeg)
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বহুদিন যাবৎ অনেক বিতর্ক চলছে।
স্বাধীনতার পর যে সকল দল রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশগ্রহণ করেছে তারা ছাড়া অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলসমূহ ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের দাবিতে সোচ্চার রয়েছে।
একটি পক্ষ মনে করেন সংসদীয় রাজনীতি বিকাশের স্বার্থে, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং সংসদ সদস্যদের কেনাবেচার সুযোগ বন্ধ করার প্রয়োজনে ৭০ অনুচ্ছেদ সুরক্ষা দিতে হবে। অতীতে সংসদ সদস্যদের কেনাবেচার সুযোগে উপমহাদেশে সকাল-বিকাল সরকার পরিবর্তন হবার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
আবার অন্য পক্ষ মনে করেন দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদ সদস্যরা দলীয় আনুগত্য পোষণ করতে করতে দলীয় ক্রীতদাসে পরিণত হন, বিবেক তাড়িত হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সুতরাং ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করা ছাড়া সংসদীয় রাজনীতি বা গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার সুযোগ থাকেনা। তাই তাঁরা গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনেই ৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ করার দাবি করছেন।
সংবিধানে রাজনৈতিক দল হইতে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোট দানের কারণে আসন শূন্য হওয়া সংক্রান্ত ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-
ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা
খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করেন,
তা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে।
১৯৭২ সালের মূল সংবিধানেই ৭০ অনুচ্ছেদে দলত্যাগ বিরোধী উপরোক্ত বিধান সন্নিবেশ করা হয়।
৭০ অনুচ্ছেদের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে,
১) যে দলের আনুগত্য পোষণ ও দলীয় মনোনয়ন লাভ করে জনগণের কাছে দলীয় কর্মসূচী বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে এবং দলীয় প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর দলের বিপক্ষে ভোট দেয়, তাতে ওই নির্বাচনী এলাকার ভোটার জনগণের সাথে প্রতারণা করা হয়;
২) দলত্যাগ এর কারণে সরকার স্থিতিশীল হতে পারে না;
৩) দলত্যাগ নৈতিকতা ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে গভীর সংকটের সৃষ্টি করে; এবং
৪) দলত্যাগ ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনীতিতে ব্যাপক দুর্নীতির জন্ম দেয় এবং দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে।
৭০ অনুচ্ছেদের বিপক্ষে যুক্তি হচ্ছে,
১) ফ্লোর ক্রসিং, দলের বিপক্ষে ভোট দেয়া, অথবা দলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ স্বরূপ সংসদে অনুপস্থিত থাকা সদস্যদের একটি গণতান্ত্রিক অধিকার, যা তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা, চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতার সাথে সম্পর্কযুক্ত;
২) ৭০ অনুচ্ছেদের আরোপিত শর্তের কারণে দলের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা যায় না;
৩) আইন প্রণয়নে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে এই বিধান প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ;
৪) একটি বিল বা সংবিধান সংশোধনী যতই অগণতান্ত্রিক হোক না কেন তা অতি দ্রুত পাস হয়ে যায়;
৫) পার্লামেন্টে আস্থা নিয়ন্ত্রণ করার চাবিকাঠি সরকারের হাতে থাকে;
৬) প্রধানমন্ত্রীর একনায়কসুলভ আচরণ করার অবাধ সুযোগ সৃষ্টি হয়; এবং
৭) ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন হলে গণতন্ত্র ও সংসদীয় রাজনীতি বিকাশে সহায়ক হবে।
ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বহু উন্নত দেশের আইন পরিষদে ভোটাভুটিতে সংসদ সদস্যদের অবাধ অধিকার থাকে। ফলে ফ্লোর ক্রসিং বন্ধ করার কোন শর্ত ঐ সকল দেশের সংবিধানে নেই এবং সংসদ সদস্য কেনাবেচার সুযোগ ও বাস্তবতাও নেই।
আমাদের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের বিধান সংযুক্ত হয়েছে তৎকালীন পাকিস্তান আমলের ২৫ বছরের রাজনীতির তিক্ত ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে। ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংসদীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে বর্বরতম ও ঘৃণ্যতম অধ্যায় রচিত হয়, যা ইতিহাসের অংশ এবং সকলের জানা।
আওয়ামী লীগ এসব কারণে প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল যে, তার দল সংসদের অভ্যন্তরে এধরনের সম্ভাব্য নৈরাজ্য রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। তাই ১৯৭২ সালের সংবিধানে সেই চিন্তা চেতনার আলোকেই আওয়ামী লীগ ৭০ অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করে।
ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে অতীত ইতিহাসের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সংবিধানে দলত্যাগ বিরোধী অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়। ভারত ১৯৮৫ সালে ৫২তম সংশোধনীর মাধ্যমে দলত্যাগ বিরোধী বিধান সংবিধানে সংযোজন করেছে।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৩(এ) ধারার ওপর প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্সে মতামত জানিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, যেসব এমপি দলত্যাগী হবেন, পার্লামেন্টে তাদের ভোট গণনা করা হবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক তাঁদের রায়ে বলেছেন, সংবিধানের ৬৩(এ) ধারার অধীনে চারটি ক্ষেত্রে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট গণনা করা হবে না। এই চারটি ক্ষেত্র হলো,
১) প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন;
২) আস্থা ভোট বা অনাস্থা ভোট;
৩) সংবিধান সংশোধনী বিল; এবং
৪) অর্থ সংক্রান্ত বিল।
কিন্তু এ রায়ে অন্যান্য ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যগণ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন কিনা এবং সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের এই রায় উপমহাদেশের রাজনীতিতে দলত্যাগ বিরোধী আইন পরিবর্তনে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।
সুতরাং উপমহাদেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং দলত্যাগের রাজনীতির চালচিত্র পর্যালোচনায় দেখা যায় রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অস্থির ও অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে অনেকের পক্ষে দলত্যাগের হাতছানি উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধিকে গোপন রাখার লক্ষ্যে মতাদর্শগত বিরোধের অজুহাতে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশে আদর্শিক রাজনীতি ও উচ্চতর সংস্কৃতি অভাব অর্থাৎ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুপস্থিতি এবং চেতনাবোধের অভাবের কারণে যে কোন সময় যে কেউ আদর্শ জলাঞ্জলি দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এসকল বাস্তবতায় অনুধাবন করা যায় বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এর ভবিষ্যৎ।
লেখক :গীতিকার
২১.০৫.২২
উত্তরা ঢাকা।