ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

একটি শব্দের বিকৃতি ১০ বছরের জেল

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

(১ বছর আগে) ২০ এপ্রিল ২০২২, বুধবার, ১২:৫৯ অপরাহ্ন

mzamin

রাজশাহীর পবা উপজেলার ২৬ বছরের এক যুবক আব্দুল মুকিত রাজু ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ২০১৭ সালে।এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একজন নেতা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেন।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালের ২৭ শে মে আব্দুল মুকিত তার ফেসবুক আইডিতে আওয়ামী লীগকে ব্যঙ্গ করে বাবা ও ছেলের কথোপকথনের ঢঙে একটা কৌতুক পোস্ট করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন আওয়ামী শব্দটি 'আইয়াম' শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ অন্ধকার, কুসংস্কার আর লীগ অর্থ দল। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ মানে অন্ধকারের দল।

এইটুকু তার অপরাধ, ব্যঙ্গ করে কৌতুক পোস্ট। আওয়ামী শব্দের যথার্থ অর্থ বিকৃত করেছেন আব্দুল মুকিত। এই অপরাধের জন্য রাজশাহীর একটা আদালত আব্দুল মুকিতকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে। শুধু তাই নয় এ অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের সাথে আব্দুল মুকিতকে আরো ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

 

অর্থাৎ 'আওয়ামী' নামক একটি শব্দ বিকৃত করার গুরুতর অপরাধের কারণে একজন যুবক সশ্রম এবং একই সাথে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত অর্থাৎ ১১ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন এই সোনার বাংলাদেশে।

একটি শব্দের বিকৃতি নিয়ে একজন মানুষের ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, তার সাথে ১০ লক্ষ টাকা অর্থ জরিমানা এবং জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছরের জেল যা বিশ্বের বিচার বিভাগের ইতিহাসে বিরল। এটা যুগান্তকারী রায়। বিচার বিভাগের ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

বিজ্ঞাপন
ঐশ্বরিক জীবনকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করার কী আন্তরিক প্রয়াস।

জাতি হিসেবে আমরা অনেক 'রোল মডেলের' জন্ম দিয়েছি। উন্নয়নে রোল মডেল, নির্বাচনে রোল মডেল, দুর্নীতিতেও আমরা রোল মডেলের খ্যাতি অর্জন করেছি।
এবার বিচার বিভাগেও 'রোল মডেল' হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির অপবাদ থেকে এবার আমাদের মুক্তি মিলবে হয়তো।
আর যে বিচারক নৈতিক কর্তব্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে রায় দিয়েছেন নিশ্চয়ই তিনি ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেবেন, পেশাগত ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা অর্জন করবেন, সহকর্মীদের দ্বারা সংবর্ধিত হবেন।
আর যে আওয়ামী লীগ নেতা তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেছিলেন নিশ্চয়ই তিনি অচিরেই দল থেকে পুরস্কৃত হবেন আরো উচ্চপর্যায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। অদূর ভবিষ্যতে আইন প্রণয়নে যুক্ত হবেন।

'আওয়ামী ' শব্দের অর্থ বিকৃত করেছেন কিন্তু মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়নি, গুমের শিকার হতে হয়নি সেটা হয়তো আব্দুল মুকিতের সৌভাগ্য।

এই মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে অভিজ্ঞ বিচারক বলেছেন, সে পোস্টের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যাচার করা হয়েছে। ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানো হয়েছে, ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের উস্কানি দেওয়া হয়েছে।

আব্দুল মুকিত কত বড় মাপের মানুষ
একটা স্ট্যাটাস দিয়ে ইতিহাস বিকৃত করে ফেলেছেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের উস্কানি দিয়েছেন, ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন এবং পরিকল্পিত ভাবে মিথ্যাচার করে উপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন। তাকে শাস্তি না দিলে সমাজে প্রলয়ংকর ঘটনা ঘটতে পারতো, রাষ্ট্র ঝুঁকিতে পড়তে পারতো।

আব্দুল মুকিতের আরো বড় শাস্তি প্রাপ্য। বাংলাদেশের মতো সমাজে থেকে 'আওয়ামী' শব্দের বিকৃত করে কারাগারের বাইরে থাকার অধিকার সংরক্ষণ করতে পারবেন না, এটা মুকিত বুঝতে পারেন নি। জীবনের সোনালী সময় কারাগারে অতিবাহিত করতে হবে এটাও হয়তো তিনি অনুধাবন করতে পারেননি। রাষ্ট্র যে কি ভয়ংকর অবস্থান গ্রহণ করেছে তাও হয়তো উপলদ্ধিতে আসেনি।

অভিজ্ঞ বিচারক আইন এবং নৈতিকতার মানদন্ডে বিচার সম্পন্ন করতে গিয়েও মানবিক কর্তব্য পালন করেছেন। ফলে মুকিত মৃত্যু দন্ডের মত চূড়ান্ত দণ্ড থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
কারণ ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধের সমকক্ষ। এটাতো রাষ্ট্রদ্রোহী।
বিচারকের পর্যবেক্ষণে যা উঠে এসেছে সে তুলনায় শাস্তি কম হয়েছে। হয়তো রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হতে পারে।

এক বছর পূর্বে ভারতের প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদে একজন আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করেছিলেন।
প্রশান্ত ভূষণের যুক্তি ছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতা তার মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। সে অধিকার থেকেই টুইটারে নিজস্ব মতামত জানিয়েছেন।

সেজন্য আদালত অবমাননার মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তারপর তাকে দোষী সাব্যস্ত করে উচ্চতর আদালত। শুধু ১ টাকা জরিমানা । জরিমানা না দিলে ৩ মাসের জেল।

প্রধান বিচারপতি অপমানিত বোধ করেছেন এবং আদালত অবমাননার দায়ে প্রশান্ত ভুষন অভিযুক্ত হয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করায় তাকে এক টাকা জরিমানা করেছে।

আমরা জানি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুটি ঐতিহাসিক কাজ করেছিল। একটি হলো পেনাল কোড (দন্ডবিধি) আরেকটি হলো ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা। একটি রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা আরেকটি সাংস্কৃতিক। বলাবাহুল্য এ দুটোই স্বাধীন বাংলাদেশ স্বমহিমায় বিদ্যমান। উপনিবেশিকতাই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক নৈতিক ও আইনের উৎস হয়ে আছে। এ কারণে স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক ভিনদেশী একটা শব্দের বিকৃতি করলেই ইতিহাস ধুলিস্যাৎ হয়ে যায় ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে বলে তাগিদ সৃষ্টি হয়।
উপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ব্যক্তির নিজস্বতা বহুমুখিতা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, সৃজনশীল বিকাশে হস্তক্ষেপ করে। একজন নাগরিকের কৌতুক বহন করার ক্ষমতা আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্রের নেই।

রায় প্রণয়নের সময় যে 'বিবেক' এবং 'নৈতিকতার' সাথে একান্ত বোঝাপড়া করতে হয় তা অনেকের বিবেচনায় নেয়ার যোগ্যতা নেই। অনেকেই শাস্তিবরাদ্দকে নৈতিক কর্তব্য বোধ মনে করেন। একটি সাধারণ ঘটনাকে বিরাট অন্যায় কাজ বলে কর্তব্য সম্পাদন করা কোন আত্মতৃপ্তির বিষয় নয়। অনেকে সংবিধানের কত বিকৃত করে ফেলে অনায়াসে, শপথ ভঙ্গ করে ফেলে অবলীলায়, প্রতিদিন মিথ্যা ছড়িয়ে দেয় সারা সমাজদেহে কিন্তু তাদের কোন বিচার হয় না। তাদের বিচারের আওতায় আনাও সম্ভব নয়।

রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীন দেশে একটি শব্দের বিকৃতি নিয়ে আব্দুল মুকিত এর ১১ বছরের কারাবাস। তাতে আমাদের কারো কোনো যায় আসে না। সমাজের যারা অসহায় তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই, যারা ক্ষমতাহীন তাদের পক্ষে রাষ্ট্র দাঁড়ায় না।
আর এই রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য
লক্ষ লক্ষ শহীদ নিশ্চয়ই আত্মবিসর্জন দেয়নি।

লেখক :গীতিকার
[email protected]
২৫.০১.২০২২

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status