মত-মতান্তর
বলির পাঁঠা ইউক্রেন: ওয়ার্ল্ড অর্ডারে নয়া মেরুকরণ
তারেকুল ইসলাম
(১১ মাস আগে) ১৯ এপ্রিল ২০২২, মঙ্গলবার, ৩:২৩ অপরাহ্ন

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এখনও অব্যাহত রয়েছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের একের পর এক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার মুখেও যুদ্ধ থেকে পিছু হটছেন না রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। তবে যুদ্ধ বন্ধের প্রধান শর্ত হিসেবে তিনি পশ্চিমা শক্তির কাছে এই গ্যারান্টি চান যে, ইউক্রেনকে কখনো ন্যাটোতে নেয়া হবে না। এছাড়া ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ করাও এ সামরিক অভিযানের লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন পুতিন। তবে কিছুটা দেরিতে হলেও এখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি পশ্চিমা সামরিক জোটে ইউক্রেনকে অন্তর্ভুক্ত করার পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে সরে এসেছেন বলে মনে হচ্ছে। কারণ তিনি ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘ইউক্রেনকে গ্রহণে ন্যাটো প্রস্তুত নয়। রাশিয়ার সঙ্গে সংঘর্ষে বা বিবাদে জড়াতে ভয় পাচ্ছে সামরিক জোটটি। তাই তার দেশ ন্যাটোতে আর যোগ দিতে চায় না’ (০৮ মার্চ ২০২২, এএফপি)।
এছাড়া জেলেনস্কি পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়া-প্রভাবিত দু’টি বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলের (দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক) ব্যাপারেও রাশিয়ার সঙ্গে ‘আপস’ করতে রাজি আছেন বলে জানিয়েছেন।
ইউক্রেনে হামলার ঠিক আগে অঞ্চল দুটিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছিল রাশিয়া। হামলা বন্ধে পুতিনের মূল তিন শর্তগুলোর একটি হলো, ওই দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন হিসেবে এবং সেই সঙ্গে ক্রিমিয়াকেও রাশিয়ার অংশ বলে ইউক্রেনকে মেনে নিতে হবে।
জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ইতিহাসের প্রফেসর জেমস হার্শবাগ ইউক্রেন সঙ্কট নিয়ে বলেছেন, ‘এটা অনেকটা শীতলযুদ্ধের প্রতিধ্বনি’। লড়াইটা বাহ্যিকভাবে রাশিয়া বনাম ইউক্রেন হলেও আদতে এটা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সেই পুরনো আধিপত্যের লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা।
নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সামরিক জোট ওয়ারশ প্যাক্টও বিলুপ্ত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটো অটুট থাকে। কিন্তু সর্বশেষ সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের সঙ্গে তাদের একটা সমঝোতা হয়েছিল যে, তারা পূর্ব ইউরোপের দিকে ন্যাটোর বিস্তার ঘটাবে না। একটা সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সেই সমঝোতা মেনে চললেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এসে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও চেক রিপাবলিককে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করেন। তখন থেকে ভূরাজনৈতিকভাবে রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইউরোপের দিকে ন্যাটোর সম্প্রসারণ বাড়াতে থাকে, যা রাশিয়ার চোখে হুমকি হিসেবে সবসময় বিবেচিত হয়ে এসেছে। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতির মনরো ডকট্রিন অনুসারে পশ্চিম গোলার্ধে অন্য কোনো পরাশক্তির সামরিক উপস্থিতি সহ্য করবে না।
যাই হোক, রাশিয়ার দুয়ারে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অব্যাহত তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে পুতিন ভূকৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিমিয়াকে দখল করে নিলে ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার সঙ্কট ঘনীভূত হয়। এরপর থেকে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সামরিক তৎপরতা আরো লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। পুতিন অনেকবার যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যাতে পূর্ব ইউরোপের দিকে ন্যাটো তার সামরিক উপস্থিতি না বাড়ায়। কিন্তু না, যুক্তরাষ্ট্র বরং সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মানের দোহাই দিয়ে ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানের অধিকারকে উৎসাহিত করেছে। যার ফলে পরিস্থিতি শেষপর্যন্ত পুতিনকে ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালাতে বাধ্য করেছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গোষ্ঠীর দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামফোসা রাশিয়ার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকে সমর্থন না করলেও ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য ন্যাটোকে দায়ী করেছেন। তবে সন্দেহ নেই, পুতিন ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব পদদলিত করে যুদ্ধাপরাধ ঘটাচ্ছেন। কিন্তু সেই সাথে এই প্রশ্ন ওঠাও প্রাসঙ্গিক যে, যুদ্ধবাজ আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো যখন ইরাক, লিবিয়া ও কসোভো-সার্বিয়াতে আগ্রাসন চালিয়ে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছিল, তখন সার্বভৌমত্বের প্রতি তাদের এই দরদ কোথায় ছিল!
ইউক্রেনে রুশ হামলার ঠিক আগেই নোয়াম চমস্কি সার্বভৌমত্বের প্রশ্নকে একপাশে রেখে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘In 2008, President George W. Bush invited Ukraine to join NATO, poking the bear in the eye. Ukraine is Russia’s geostrategic heartland, apart from intimate historic relations and a large Russia-oriented population. Germany and France vetoed Bush’s reckless invitation, but it’s still on the table. No Russian leader would accept that, surely not Gorbachev, as he made clear.’ (February 2022 Issue, Rozenberg Quarterly).
সুতরাং, ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণেই ইউক্রেনকে কখনো রাশিয়ার বলয় থেকে বের করে পশ্চিমা বলয়ে নেয়া সম্ভব নয়। সে কারণে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ২০১৪ সালের ৫ই মার্চ ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত তার এক কলামে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ইউক্রেনের উচিত পশ্চিম ও পূর্বের মধ্যে সেতু হিসেবে ভূমিকা পালন করা, ‘দুই পক্ষের যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবে নয়। এছাড়া আমেরিকার প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও শিকাগো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জন মেয়ারশাইমার নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তার এক কলামে পশ্চিমা বিশ্বকে ইউক্রেন সঙ্কট সমাধানের উপায় বাতলে দিয়ে লিখেছিলেন, ‘To save Ukraine and eventually restore a working relationship with Moscow, the West should seek to make Ukraine a neutral buffer state between Russia and NATO. It should look like Austria during the Cold War. Toward that end, the West should explicitly take European Union and NATO expansion off the table, and emphasize that its goal is a nonaligned Ukraine that does not threaten Russia. The United States and its allies should also work with Mr. Putin to rescue Ukraine’s economy, a goal that is clearly in everyone’s interest.’ (8 Feb. 2015, New York Times).
দুর্ভাগ্যের বিষয়, যুদ্ধবাজ আমেরিকা ওসব শান্তিপূর্ণ পরামর্শের কোনোটিই গ্রাহ্য করেনি। বরং ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্রমাগত উসকানি ও প্ররোচণা দিয়ে আমেরিকা তার সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী খায়েশ চরিতার্থ করতে গিয়ে খোদ ইউরোপেই আজ যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছে। অথচ প্রকৃত বাস্তবতা হলো, নানা হিসাব-নিকাশ থেকে ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে নেয়ার ক্ষেত্রে ন্যাটোর প্রভাবশালী কয়েকটি ইউরোপীয় রাষ্ট্র সম্মত নয়। বিশেষত গ্যাসের ক্ষেত্রে ইউরোপ রাশিয়ার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। সমগ্র ইউরোপের প্রায় ৪৩ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাসপ্রোম। আবার রুশ অর্থনীতি প্রধানত তেল-গ্যাস রপ্তানির ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশে রাশিয়ার তেল-গ্যাস আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। একই পদক্ষেপ নিতে দেশটি ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানালেও কোনো সাড়া পায়নি। এছাড়া ইউরোপের ৩০ শতাংশ তেলও সরবরাহ করে রাশিয়া। যদিও তেলের জন্য রাশিয়ার বিকল্প রয়েছে ইউরোপের কাছে। কিন্তু ইউরোপ যদি রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করে, তাহলে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে রাশিয়া। অন্যদিকে, জামানির বৃহত্তম আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘ডয়েচে ব্যাংক’ রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাসমূহের সঙ্গে একমত পোষণ করলেও তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, ‘সুইফট সিস্টেম থেকে রাশিয়াকে বাদ দেয়ার ফলে একটি ‘অথনৈতিক বিপদ’ তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জটিল হয়ে ওঠবে এবং অস্থিরতা তৈরি হবে।’ এছাড়া ব্যাংকটির ম্যাক্রো স্ট্র্যাটেজিস্ট মেরিয়ন লেবোওর সতর্ক করে বলেছেন, ‘এই নিষেধাজ্ঞাটা সুইফটের বিকল্প হিসেবে লেনদেনের জন্য পশ্চিমাবিরোধী দেশগুলোর নিজস্ব সিস্টেমগুলোর সম্প্রসারণকে বেগবান করতে পারে, যা নিষেধাজ্ঞাগুলোকে উতরে যাবে’ (১১ মার্চ ২০২২, দ্য টেলিগ্রাফ, লন্ডন)। এরই মধ্যে রাশিয়ান ব্যাংকগুলোর জন্য সুইফটের বিকল্প হিসেবে চাইনিজ ক্রস বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম (সিআইপিএস) প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এটা সত্য, ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমাদের একের পর এক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রুশ অর্থনীতি লক্ষণীয়ভাবে বেকায়দায় পড়েছে। এর আগে ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করার পর থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে প্রতি বছর রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ কমে গিয়েছিল; অর্থাৎ, বছরে রুশ অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৫০ বিলিয়ন ডলার করে। সুতরাং, সাম্প্রতিক নতুন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো মোকাবেলায় রাশিয়া ক্রিপ্টোকারেন্সি (ডিজিটাল কারেন্সি) ব্যবহার করতে পারে বলে জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য রাশিয়ার কাছে ক্রিপ্টোকারেন্সির পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। রাশিয়ার শুধু বাণিজ্য করার এমন একটি পথ দরকার, যা ডলারের মুখাপেক্ষী নয়। ফলে সুইফট সিস্টেম থেকে বাদ দেয়াসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিলেও পশ্চিমাদের পক্ষে রাশিয়ার অর্থনীতিকে এত সহজে রুদ্ধ করা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে দূর থেকে যতই সমর্থন ও সহায়তা দিক না কেন, রাশিয়ার নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলে ন্যাটোতে ইউক্রেনকে নেয়ার ঝুঁকি নিতে ইউরোপ প্রস্তুত বা সক্ষম নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করা ছাড়া ইউক্রেনের আর কোনো উপায় থাকছে না। অপরপক্ষে, পুতিন বারবার বলেছেন, তার মূল শর্তগুলো মেনে নেয়া হলে তিনি মুহূর্তেই হামলা করা বন্ধ করে দিবেন। তার আরেকটি মূল শর্ত: ইউক্রেনকে সামরিক ক্ষেত্রে অস্ট্রিয়া ও সুইডেনের মতো নিউট্রাল তথা নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হবে। অর্থাৎ, ইউক্রেনের নিজস্ব সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকলেও দেশটি কোনো সামরিক জোটে যুক্ত হতে পারবে না এবং নিজ ভূমিতে কোনো বিদেশি সামরিক ঘাঁটি গড়তে দিবে না। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে উভয়পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে যাচ্ছে বলে সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র এত দ্রুত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধটা শেষ হতে দিবে। কারণ এ যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রি কমপ্লেক্সের অস্ত্রব্যবসাও রমরমা হয়ে উঠেছে। বাইডেন আরো একশ কোটি ডলারের অস্ত্র ইউক্রেনে পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছেন (১৭ মার্চ ২০২২, প্রথম আলো)। সুতরাং, এ যুদ্ধ যত প্রলম্বিত হবে, পশ্চিমাদের প্রতিরক্ষা শিল্পখাত ততই ফুলে ফেঁপে উঠবে।
এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ওয়ার্ল্ড অর্ডারে নয়া মেরুকরণ লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। যদিও সোভিয়েত-পরবর্তী মার্কিন নেতৃত্বাধীন এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় সেই মেরুকরণের সূচনা হয় ২০১৫ সালের অক্টোবরে সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রবল প্রতাপে অংশগ্রহণের পর থেকে। যাইহোক, ইউক্রেন ইস্যুতে ঠিক যখন রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে, তখন রাশিয়ার কৌশলগত সহযোগী চীনের কাছে সৌদি আরব ডলারের পরিবর্তে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের বিনিময়ে কিছু পরিমাণে তেল বিক্রি করতে রাজি হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সৌদি রাজতন্ত্রকে রক্ষায় মার্কিন নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে দেশটি অসন্তুষ্ট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারের পরিবর্তে ইউয়ান বা অন্য কোনো মুদ্রায় মধ্যপ্রাচ্যের তেল বাণিজ্য শুরু হলে বৈশ্বিক পেট্রোলিয়াম বাজারে ডলারের আধিপত্য কমতে পারে। তেল বাণিজ্যের জন্য ডলারের বিকল্প মুদ্রা বা উপায় খোঁজার বিষয়টি আজকে নতুন নয়। প্রয়াত বৃটিশ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক ২০০৯ সালের ৪ঠা মার্চ দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় এক কলামে লিখেছিলেন, 'In the most profound financial change in recent Middle East history, Gulf Arabs are planning – along with China, Russia, Japan and France – to end dollar dealings for oil, moving instead to a basket of currencies including the Japanese yen and Chinese yuan, the euro, gold and a new, unified currency planned for nations in the Gulf Co-operation Council, including Saudi Arabia, Abu Dhabi, Kuwait and Qatar.’ সন্দেহ নেই, পেট্রোডলার ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটলে সেটা ওয়ার্ল্ড অর্ডারে আমেরিকাকে নখ-দন্তহীন বাঘে পরিণত করবে। এছাড়া ইউক্রেনের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি রোধ করার ব্যাপারে বাইডেন ফোন করেছিলেন সৌদি আরব ও আরব আমিরাতকে। কিন্তু তারা কেউই ফোন ধরেনি (৮ই মার্চ ২০২২, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল)। এমনকি ভারত-পাকিস্তানও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়ার সাথে গ্যাস ও তেল বাণিজ্য অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার মানে, বিদ্যমান ওয়ার্ল্ড অর্ডারে আমেরিকার আগের সেই একচেটিয়া কর্তৃত্ব ও আধিপত্য যে আর বজায় নেই, তা বলা বাহুল্য। অন্যদিকে, আমেরিকার বিপরীতে অর্থনৈতিকভাবে চীনের নতুন বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। নিকট ভবিষ্যতে বৈশ্বিক নেতৃত্ব চীন-রাশিয়ান ব্লকের হস্তগত হলে বিশ্বব্যবস্থার নতুন বিন্যাস ও রূপ অবধারিত হয়ে উঠবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Email: [email protected]