ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২০ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

বড় প্রকল্পে চোখ, সঞ্চালনে দুর্বলতা

কেন এই বিপর্যয়?

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
৬ অক্টোবর ২০২২, বৃহস্পতিবার
mzamin

ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় গত মঙ্গলবার ব্ল্যাকআউট ছিল দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকা। এই সময়ে চরম বিপর্যয়কর এক পরিস্থিতি তৈরি হয়। ভুতুড়ে  অবস্থা বিরাজ করে রাজধানী ঢাকায়। নানা চেষ্টায় মঙ্গলবার রাতের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। এখন চলছে এই ঘটনার কারণ অনুসন্ধান। কাজ করছে তদন্ত কমিটি। এখন পর্যন্ত কেন এই ঘটনা ঘটেছে তার কোনো কারণ জানাতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ।  বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সাইবার থ্রেড অথবা অপারেশনাল এরর-এর কারণে এ ধরনের গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। মঙ্গলবারের ঘটনার পেছনে  কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল না। সাইবার থ্রেটের বিষয়েও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো তথ্য জানানো হয়নি। তার মানে এখানে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণেই এমন পরিস্থিতি হয়েছে। আর সেটি হলে সঞ্চালন ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের দায় নিতে হবে।  কি কারণে জাতীয় গ্রিডের বিপর্যয় হতে পারে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ মানবজমিনকে বলেন,  জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হতে পারে দুটি। প্রথমত, অবহেলা। সাধারণ তিন মাস পরপর সঞ্চালন লাইনে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এর আগে যাতে খারাপ না হয় সেজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করা। এখন রক্ষণাবেক্ষণে নজর কম। তিনি বলেন, বিদ্যুতের সঞ্চালন ব্যবস্থায় অর্থ কম। কমিশন কম। তাই এদিকে নজরও নেই। দ্বিতীয় কারণ  হচ্ছে দুর্নীতি। 

যেখানে বড় বড় প্রকল্প আছে সেখানে বিরাট টাকার উৎস। সেখানে নজর বেশি। কাজও হয়। এখানেই চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পরপরই এর কারণ বলা উচিত ছিল। ব্রেকার ও সাব-স্টেশনে কী হয়েছিল। তা বলেনি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনের সঙ্গে সঞ্চালন ব্যবস্থা সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। অবহেলিত থেকে গিয়েছে সঞ্চালন ব্যবস্থায় বিনিয়োগও। এ নিয়ে গৃহীত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতিও এখন পর্যন্ত খুব একটা সন্তোষজনক নয়। সর্বশেষ মঙ্গলবার দুপুরে দেশব্যাপী জাতীয় গ্রিডের বিপর্যয় এ সংকটকেই আবারো সামনে তুলে এনেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ হলো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামোর আধুনিকায়ন। আমাদের বিদ্যুৎ খাতে বেশি গুরুত্ব পায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামোয় বিনিয়োগ, নির্মাণ অগ্রগতিতে বরাবরই ধীরগতি দেখা গিয়েছে। যে কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো গেলেও সঞ্চালন অবকাঠামোর অভাবে তা পরিপূর্ণভাবে পরিচালন করা যায়নি। 

এর আর্থিক ক্ষতিও এখন আমরা দেখছি। বিদ্যুৎ বিপর্যয় প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের তদন্ত কমিটি কাজ করছে। কমিটি বুধবার সকালে ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে গেছে। কমিটি এলে আমরা প্রাথমিক ধারণা পাবো। তার আগে বলা যাচ্ছে না কী কারণে সমস্যা হয়েছিল। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের বিষয়ে সচিব বলেন, ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুটি সাব-স্টেশনের মাঝখানে যে ইন্টার কানেকশন রয়েছে, সেখানেই মূলত সমস্যা। কিন্তু সমস্যাটা কেন হলো সেটা এখনো জানা যায়নি। তা উদ্ঘাটনের জন্য আমাদের অভিজ্ঞ টিম সেখানে গেছে। এদিকে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের এক প্রকৌশলী জানান, এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না। তদন্ত দল ঘুরে ঘুরে সব দেখছে। তারা প্রতিবেদন দেবেন। মূল কারণ না জানার আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না। দেশে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি করে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। বিভ্রাট প্রসঙ্গে কর্মকর্তারা বলেন, গ্রিড লাইনের এক সেকেন্ডের জটিলতা দীর্ঘ সময়ের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। এটি যেকোনো সময় ঘটতে পারে। তবে ভোল্টেজ ওঠানামা বা ওভারলোডের মতো জটিলতা দেখা দিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। এর আগে ২০১৪ সালের ১লা নভেম্বর জাতীয় গ্রিডে এমন বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। 

ওই সময় ভেড়ামারায় ভারত ও বাংলাদেশের সঞ্চালন লাইনের সংযোগস্থলের ত্রুটি থেকে এ বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটেছিল। পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ দেশে এখন বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় পৌনে ২৬ হাজার মেগাওয়াট। যদিও এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে চলতি ২০২২ সালের ১৬ই এপ্রিল। ওই দিন দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। উৎপাদন সক্ষমতা সর্বোচ্চে পৌঁছলেও এখনো সঞ্চালন ব্যবস্থার দুর্বলতা রয়েই গেছে। যদিও গত এক দশকে এ দুর্বলতা কাটাতে অর্ধশতাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে পিজিসিবি। সংস্থাটির প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। পিজিসিবি-সংশ্লিষ্টরাও বিভিন্ন সময়ে দেশের সঞ্চালন ব্যবস্থার দুর্বলতার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে এ দুর্বলতার জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গ্রামেগঞ্জে ছড়ানো-ছিটানো লাইন, সিস্টেম দুর্বলতা, পুরনো প্রযুক্তিসহ নানা বিষয়কে দায়ী করেছেন তারা। সঞ্চালন ব্যবস্থায় দুর্বলতা থেকে গেলেও বিদেশি ঋণে বিদ্যুৎ খাতের মনোযোগ এখনো একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেই। দেশে বিদ্যুৎ খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। 

সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা সঞ্চালন ব্যবস্থার ঘাটতিতে উৎপাদন সক্ষমতা সময়মতো কাজে লাগাতে না পারার বড় উদাহরণ হতে যাচ্ছে প্রকল্পটি। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সিংহভাগ অর্থায়ন করেছে রাশিয়া। প্রকল্পে দেশটির দেয়া ঋণের পরিমাণ ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের শেষ নাগাদ প্রকল্পটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনক্ষম হয়ে ওঠার কথা রয়েছে। কিন্তু সাত প্যাকেজের আওতায় বাস্তবায়নাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজে এখন পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি ৪০-৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে যমুনা ও পদ্মা নদীর এপার-ওপার সঞ্চালন লাইন নির্মাণে গৃহীত প্যাকেজটির অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। কাজ এগিয়ে নিতে এরই মধ্যে প্যাকেজটিকে ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে পিজিসিবি। এ কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে কোনো তথ্য দিতে পারছে না কেউই। প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৭ সাল নাগাদ। সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়ন না করে বা সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ খাতের অব্যবস্থাপনাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এলে তা সার্বিকভাবে সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status