মত-মতান্তর
কোভিড ও ডেঙ্গুর দোফলা আক্রমণ
ড. মাহফুজ পারভেজ
(৫ মাস আগে) ২ অক্টোবর ২০২২, রবিবার, ১২:১৮ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৬:৫৬ অপরাহ্ন

মোটেও নিঃশেষ হয়ে যায় নি করোনাভাইরাসের দাপট। মাঝে মাঝেই চোখ রাঙাচ্ছে আর একই সঙ্গে নগরে তাণ্ডব চালাচ্ছে ডেঙ্গু জ্বর। কোভিড ও ডেঙ্গুর দোফলা আক্রমণে জেরবার জনজীবন। চিকিৎসা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য কাঠামো রয়েছে ভয়ানক চাপের মধ্যে। বিশেষত রাজধানীর হাসপাতালে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা।
সারা বছর মশার চাষ করে এখন মৃত্যুর ফসল তুলতে হচ্ছে, যার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনের বাড়বাড়ন্ত পরিসংখ্যানে। একজনের মৃত্যুসহ একদিনে রেকর্ড ৬৩৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে এ বছর ৫৬ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। নতুন ডেঙ্গু রোগী নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৫৮ জনে। চলতি বছরের ১লা জানুয়ারি থেকে ১লা অক্টোবর পর্যন্ত হাসপাতালে সর্বমোট রোগী ভর্তি ছিলেন ১৬ হাজার ৭২৭ জন। সেপ্টেম্বর মাসে দেশে সর্বমোট ৯ হাজার ৯১১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
আমাদের শহরগুলো যে ডেঙ্গুর সূতিকাগার তা আমরা চোখে দেখতে পাই না।
সাধারণ জীবনযাত্রার আনন্দ ও স্বস্তি ম্লান করে দিয়ে এক-একটি এলাকায় বিষাক্ত ধোঁয়ার মতো ছড়াচ্ছে রোগের আতঙ্ক। এমন ভয়ানক সঙ্কট যে অকস্মাৎ হয়েছে, এমন নয়। বর্ষার পর মশার প্রকোপ বাড়লে ডেঙ্গু দেখা দিতে পারে, সময় থাকতে মশা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, এ কথা বিশেষজ্ঞরা বছরের সব সময়ই বলে আসছেন। বিশেষত তাঁদের উদ্বেগ ছিল কোভিড ও ডেঙ্গুর দোফলা আক্রমণ নিয়ে। কোভিডের আক্রমণে দেহের প্রতিরোধ শক্তি দুর্বল হলে আরও ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে যে কোনও সংক্রামক অসুখ, এ কথা এত দিনে প্রতিষ্ঠিত। এসব সত্য ও বাস্তবতাকে যথাসময়ে আমলে না নেওয়ায় বিপদ মারাত্মক আকার ধারণ করছে।
এমনিতেই সমস্যার অন্ত নেই চিকিৎসার পরিকাঠামো নিয়ে। দলে দলে লোক দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে চিকিৎসার প্রয়োজনে। যাদের সামর্থ্য নেই, তারা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে চিকিৎসার আশায় ছুটতে ছুটতে লবেজান হচ্ছে। তদুপরি, কোভিড কীভাবে চিকিৎসাব্যবস্থাকে ব্যস্তসমস্ত ও প্রায়-বিপর্যস্ত করে রেখেছিল, সে অভিজ্ঞতা এখনো মিলিয়ে যায় নি। কোভিডের অভিজ্ঞতার আলোকে ডেঙ্গু মোকাবেলায় সক্ষমতা দেখানোও দরকার ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি দেখে তেমন আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।
কোভিড ও ডেঙ্গু উভয়টিই পূর্ব-সচেতনতার মাধ্যমে কমানো যায়। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি করোনাভাইরাসের বিস্তার কমায়। আর পরিবেশের সুরক্ষা ও পরিচ্ছন্নতা ডেঙ্গুর বিস্তার হ্রাস করে। সময় মতো পূর্ব-সচেতনতা না নেওয়া হলে কেমন বিপদ হতে পারে, তা প্রমাণিত। কোভিডের মতো ডেঙ্গু তীব্র ও ব্যাপক হারে দেখা দিলে কেবল সময়োপযোগী চিকিৎসার অভাবে বহু রোগী বিপন্ন হবেন, তাঁদের মৃত্যুও হতে পারে। তাই ডেঙ্গুকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। মশার লার্ভা সময় থাকতে মারলে ডেঙ্গু ছড়াবার সম্ভাবনাই কমে যায়।
যথারীতি সেই সুপরামর্শ উপেক্ষিত হয়েছে। এ বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল, আগস্টের মাঝামাঝি সময় থেকে তা আরও ছাড়িয়ে যায়। সেপ্টেম্বর থেকে আরও দ্রুত গতিতে ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু, প্রতি দিন নতুন নতুন সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। আক্ষেপ এই যে, কোভিডের মতো বিপর্যয় দেখার পরেও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও সুপরিকল্পিত, আরও তৎপর তো করা হয়নি।
উপরন্তু রাজধানীর নানা পরিষেবায় যে উন্নতি দরকার ছিল, তা হয়ে বরং সেগুলোরও ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। ফের পথেঘাটে স্তূপীকৃত আবর্জনা দেখা যাচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিপাতেই জলাবদ্ধ হচ্ছে। দিনের পর দিন পানি আটকে থাকছে। প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহারেও রাশ টানা হয়নি। ফলে প্রবল বৃষ্টির পর রাস্তার পানি যদি বা কিছুটা নামে, নিচু জমিতে তা দাঁড়িয়েই থাকে। দখল ও আবর্জনায় প্রায়-বন্ধ ড্রেন, নালা দিয়ে পানি মোটেও প্রবাহিত হতে পারে না।
অন্যদিকে অবৈধ নির্মাণ কখনওই নিয়ন্ত্রিত হয়নি, এখনও অব্যাহত। এতে জলাভূমি, নিচুজমি দখল হচ্ছে। ঢাকার চারপাশের জলাধারগুলো গিলে খেয়েছে ভূমিদস্যুর দল। এদেরকেও নিবৃত্ত করা হয় নি। অনুমোদন বিহীন নির্মাণের ফলেও পাবলিক স্পেস কমছে। আবার অনুমোদনের অভাবে আটকে থাকা বা মাঝপথে পরিত্যক্ত সরকারি ও বেসরকারি নির্মাণগুলো হয়ে উঠেছে মশার আঁতুড়ঘর।
এসবের কোনওটাই অজানা বিষয় নয়। জন্মলগ্ন থেকে এই নগরী মশার সঙ্গে মোকাবিলা করে চলেছে। বঙ্গদেশেই একদা রোনাল্ড রস ম্যালেরিয়ার রহস্য খুঁজে পেয়েছিলেন। তবু মশকের বিরুদ্ধে পরিচ্ছন্নতামূলক প্রতিরোধক ব্যবস্থা জোরদার করতে পারে নি নগরের সেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান।
ডেঙ্গুর আগ্রাসনের কবল থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন সারা বছর ধরে কীট-পতঙ্গের নিয়ন্ত্রণ, আবর্জনা ও নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি, নাগরিকের সঙ্গে পৌর প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত কর্মসূচি। কিন্তু তা হচ্ছে কোথায়? স্থায়ী জনস্বাস্থ্যকে কর্তারা বার বার আপৎকালীন চিকিৎসার সঙ্গে এক করে ফেলেন। সঙ্কট দেখা দিলে শোরগোল ফেলেন। তারপরই আবার সবকিছুই ভুলে যান। কিছুই বদলায় না। কোভিডের পর ডেঙ্গু আসে। জনস্বাস্থ্যের বিপদগুলো চক্রাকার আবর্তিত হতে থাকে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, অধ্যাপক ও বিশ্লেষক।